উইঘুর মুসলিমদের উপর চীনা নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা লেখাঃ ইয়াসিন আরাফাত

উইঘুর মুসলিমদের উপর চীনা নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা

উইঘুর মুসলিমদের উপর চীনা নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা

লেখাঃ ইয়াসিন আরাফাত

প্রায় ৯৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তন চীনের, আর তাদের জনসংখ্যা ১৪৪ কোটি। চীনের প্রদেশ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রদেশ শিনজিয়াং। চীনে ৪০ হাজার মসজিদের মধ্যে ২৫ হাজারই শিনজিয়াং প্রদেশে। ২০০৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী শিনজিয়াংয়ে দেড় কোটি উইঘুর মুসলিমদের বসবাস।

চীন বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এই বৌদ্ধ ধর্মলম্বীরা মিয়ানমারে ইতিহাসের হিংস্র এবং ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা, জ্বলন্ত আগুনে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, গুম, ধর্ষন, ঘর বাড়ি জালিয়ে দেওয়াসহ এমন কোন অন্যায় অপরাধ তারা বাদ রাখেনি।

তাদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাদ যায়নি সেখানে বসবাসরত হিন্দুরাও।

এতো গেল হিংস্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কথা। এবার আসা যাক তাদের উত্তরসূরী চীনাদের কথায়।

চীনারা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে অসভ্য জাতী, অসভ্যতার সাথে সাথে তাদের হিংস্রতাও ফুটে উঠেছে শিনজিয়াংয়ে।বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯০ লাখ মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষ বন্দি রয়েছে বন্দি শিবিরে। চীন সরকার এ বন্দি শিবিরকে ‘চরিত্র সংশোধনাগার’ নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উশৃংঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম। চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এ সব মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্র জানায়, জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীন সরকারের বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিমদের বন্দি করা এখনো থামেনি।

মুসলিম নির্যাতনের এসব তথ্য যাতে চীনের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য তারা প্রতিনিয়িত মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগে বিধি-নিষেধ আরোপ করছে। সরকারিভাবে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য জিনজিয়াং প্রদেশে ভ্রমণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

চীন সরকার কর্তৃক এসব অত্যাচার নির্যাতনে এখনও কোনো উইঘুর মুসলিম প্রতিরোধমূলক কিংবা আত্মরক্ষামূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তারপরও দেশটির সরকার উইঘুর মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে বর্হিবিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে প্রবাহিত করছে। অথচ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি তারা।

শিনজিয়াংয়ে তাদের অন্যায় অত্যাচারের কিছু উল্লেখযোগ্য খবরের শিরোনাম –

  • মুসলিম গর্ভবর্তী নারীদের অবৈধভাবে গর্ভপাত করানো হচ্ছে আবার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছেলেদের কাছে মুসলিম মেয়েদের জোরপূর্ব বিয়ে দেয়া হচ্ছে বলেও বয়েছে ব্যাপক অভিযোগ।(বিবিসি)
  • সম্প্রতি জিনজিয়াং প্রদেশের যে কোনো একটি শহরকে ভূগর্ভস্থ পারমানবিক পরীক্ষা ও বিষ্ফোরণের জন্য বাছাই করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করছে চীন সরকার। ১৯৬৪ সাল থেকে জিনজিয়াং প্রদেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি ক্ষতিকর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।(বিবিসি)
  • জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য চীনের সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে তাতে জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের জনসংখ্যা আগামী ২০বছরে এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।(বিবিসি)
  • উইঘুর মুসলিমদের ‘গণহত্যা’ চলছে: ক্যানাডা (ডি.ডব্লিউ)
  • উইঘুর মুসলিম নির্যাতনে শি জিনপিংসহ শীর্ষ নেতারা, তথ্য ফাঁস (সময় নিউজ)
  • রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন কেন সবসময় মিয়ানমারের পক্ষে? (বিবিসি)

এমন শতশত খবর আছে যেগুলো সাংবাদিকদের অদেখা, কারন চীনারা এমন কৌশলে নির্যাতনগুলো চালাচ্ছে যাতে তাদের দেশের বাহির পর্যন্ত না যায়। উইঘুর বন্দিশিবির গুলোকে ১০০ ভাগ সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে এবং সেখানে কোন দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না চীনা কমিউনিস্ট জালিম সরকার।

বিবিসি নিউজের গত বছরের এক প্রতিবেদনে জানতে পেরেছিলাম চীনে উইঘুর নারীরা গণধর্ষণের শিকার শিনজিয়াংয়ের বন্দী শিবির গুলোতে এবং তাদের লক্ষ্য সবাইকে নিশ্চিন্হ করে দেওয়া।

শিনজিয়াংয়ের বন্দী শিবিরের কয়েকজন নারীর মুখ থেকে প্রকাশিত কিছু কথা শেয়ার করলাম যারা পরবর্তীতে সেখান থেকে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে-

এই নারীদের একজন হচ্ছেন তুরসুনে জিয়াউদুন। সংবাদ মাধ্যমে দেয়া তার এই বর্ণনা ছিল- তখন কোন মহামারি চলছিল না কিন্তু ওই লোকগুলো সবসময়ই মুখোশ পরে থাকতো। “তারা স্যুট পরতো, পুলিশের পোশাক নয়। কখনো কখনো তারা আসতো মধ্যরাতের পরে। সেলের মধ্যে এসে তারা ইচ্ছেমত কোন একজন নারীকে বেছে নিতো। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডোরের আরেক মাথায় ‘কালো ঘর’ বলে একটি কক্ষে। ওই ঘরটিতে নজরদারির জন্য কোন ক্যামেরা ছিল না।”

জিয়াউদুন বলেন, বেশ কয়েক রাতে তাকে এভাবেই নিয়ে গিয়েছিল ওরা।

“হয়তো এটি আমার জীবনে এমন এক কলঙ্ক – যা আমি কখনো ভুলতে পারবো না”- বলছিলেন তিনি।

“এসব কথা আমার মুখ দিয়ে বের হোক – এটাও আমি কখনো চাইনি।”

শিনজিয়াং প্রদেশে চীনের এইসব গোপন বন্দী শিবিরের একটিতে তুরসুনে জিয়াউদুন বাস করেছেন মোট ৯ মাস।

তিনি বলছেন, ওই সেলগুলো থেকে প্রতিরাতে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তার পর মুখোশ পরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ তাদের ধর্ষণ করতো।

জিয়াউদুন বলেন – তিনি নিজে তিনবার গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

প্রতিবারই দুই বা তিন জন লোক মিলে এ কাজ করে।

অন্য আরেক নারীর বর্ণনা- তিনি হচ্ছেন কাজাখ নারী গুলজিরা আউয়েলখান।

তাকে বাধ্য করা হয়েছিল উইঘুর নারীদের কাপড় খুলে তাদের উলঙ্গ করতে, এবং তারপর তাদের হাতকড়া লাগাতে।

তার পর তিনি ওই নারীদের একটি ঘরে রেখে যেতেন – যেখানে থাকতো কয়েকজন চীনা পুরুষ।

পরে, তার কাজ ছিল ঘরটা পরিষ্কার করা।

“আমার কাজ ছিল ওই মেয়েদের কোমর পর্যন্ত কাপড়চোপড় খোলা এবং এমনভাবে হাতকড়া লাগানো যাতে তারা নড়তে না পারে। তাদের ঘরে রেখে আমি বেরিয়ে যেতাম।

“তার পর সেই ঘরে একজন পুরুষ ঢুকতো। সাধারণত বাইরে থেকে আসা কোন চীনা লোক, বা পুলিশ। আমি দরজার পাশে নিরবে বসে থাকতাম। লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি ওই নারীটিকে স্নান করাতে নিয়ে যেতাম।”

গুলজিরা বলছিলেন, “বন্দীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও কমবয়স্ক মেয়েদের পাবার জন চীনা পুরুষরা টাকাপয়সা দিতো।”

এতে বাধা দেয়া বা হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা তার ছিল না। কিছু সাবেক বন্দীকেও বাধ্য করা হতো প্রহরীদের সাহায্য করতে। সেখানে পরিকল্পিত ধর্ষণের ব্যবস্থা ছিল কিনা প্রশ্ন করে গুলজিরা আওয়েলখান বলেন, “হ্যাঁ, ধর্ষণ।”

এছাড়াও আরো একজন নারীর ভাষ্যমতে, নারীদের গর্ভপাত ঘটাতে বাধ্য করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। কেউ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আবার কেউ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে নগ্ন হয়ে গোসল করতে বাধ্য করা এবং গোপনাঙ্গে মরিচের গুড়া ডলতে বাধ্য করার মতো ঘটনা।

সম্প্রতি আল-জাজিরায় প্রকাশিত হয়েছে “হাজারো গোপন ছবিতে উইঘুর মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের চিত্র” এমন একটি প্রতিবেদন যেখানে বলা হয়েছে চীনের বিরুদ্ধে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের বিভিন্ন বন্দিশিবিরে উইঘুর জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর গণহত্যা এবং নির্যাতন চালানোর অভিযোগ নতুন নয়। তবে বেইজিং সরকার বরাবর এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সম্প্রতি নির্যাতনের ঘটনার ওপর হাজার হাজার ছবি ও কিছু সরকারি গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। এসব ছবি ও নথি নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতাকেই যেন বিশ্ববাসীর সামনে আরেকবার তুলে ধরেছে।

এবার আরেকটা নির্যাতনের প্রতিবেদন বলছি যেটা শুনলে হয়ত আপনার গা শিউরে উঠবে- ‘হেরাল্ড সান’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় দেড় লক্ষ মানুষকে জোর করে বন্দি করা হয়েছে। বন্দি অবস্থায় এই মুসলমানদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি জোরপূর্বক কেটে অপসারণ করা হচ্ছে।

চিনে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি চলছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থানও ধ্বংস করা হচ্ছে।

এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে উইঘুর মুসলমানদের তাঁদের বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে ‘শিক্ষা কেন্দ্রে’ পাঠানো হচ্ছে। সংবাদপত্রের মতে, বন্দিদের প্রচণ্ড মারধর করা হচ্ছে। চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। মারধর করে তাঁদের মিথ্যা অপরাধও স্বীকার করানো হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা ঠেকাতে নারীদের ব্যাপকভাবে বন্ধ্যাকরণ করা হচ্ছে।

এএসপিআই রিপোর্টের উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রটি বলেছে যে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ৮০,০০০ উইঘুর মুসলমানকে দেশের বিভিন্ন কারখানায় পাচার করা হয়েছিল। বাড়ি থেকে দূরে এইসব কারখানায় তাঁদের আলাদা করে রাখা হয়। কাজ শেষে তাঁদের তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কোনও ধর্মীয় কাজে অংশ নিতে দেওয়া হয় না।

প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে বছরে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা মূল্যের অঙ্গ কালোবাজারি হয়। যে হাসপাতালগুলিতে মানুষের অঙ্গ সরানো হয়, সেগুলি এই আটক কেন্দ্রগুলি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপাতালে করা অপারেশনের তথ্য এবং ছোট্ট ওয়েটিং লিস্ট থেকেই বোঝা যায় যে বলপূর্বক অঙ্গ অপসারণের এই কারবার দীর্ঘদিন ধরেই চলছে।

চায়না কমিউনিস্ট সরকার বিশ্বের স্মরণকালের অতীত বর্বোরোচিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, জেনোসাইড করছে ইউঘুর মুসলিমদের উপর। তাদের কে তাদের নিজ বাড়ীতে থাকতে দেয়া হচ্ছে না, জোর পূর্বক ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে। তাদের ভাষায় কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না, ভাষা ও সংস্কৃতি চিরতরে বিনষ্ট করা হচ্ছে। তাদের কে নামাজ-রোযা ও যাবতীয় ধর্মীয় কার্যাবলী/কর্মকান্ড করতে দেয়া হচ্ছে না।

সিসিটিভির আওতায় তাদের কে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মৌলিক ও নাগরিক অধিকার ১০০ ভাগ কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাদের মোবাইলে পর্যন্ত স্পাই সফটওয়্যার ইনস্টল করা হয়েছে।

এমন অসংখ্য এবং এর চাইতে ভয়াবহ হিংস্র নির্যাতনের খবর আছে যেটা হয়ত চীনের বাহিরে বের হয় না। তাই আমরা জানতে পারি না। তবে বিশেষজ্ঞদরে মতে নির্যাতনের ২০ ভাগও হয়ত আমরা জানছি না।

ফিলিস্থিন, সিরিয়াসহ অন্যান্য দেশে মুসলিম নির্যাতনের খবর অহরহ শুনি আমরা প্রতিবাদও করি, কিন্তু চীনাদের গোপনীয়তার কারনে উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতনের খবর বিশ্ববাসির কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমাদের মুসলিম বিশ্বের নেতারা শুধু মুখেই বড় কথা বলে কাজের বেলায় কোন পদক্ষেপ গ্রহন করে না। তাদের বলি জেগে উঠুন, নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়ান।

আমাদের সকলের উচিত চায়নার ইউঘুর প্রদেশের মুসলিমদের সাহার্য্যার্থে এগিয়ে আসা এবং যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করা।

——————————–

লেখাঃ ইয়াসিন আরাফাত

ফেইসবুক : https://www.facebook.com/staywitharafats/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top