দর্শন কী এবং দর্শনের উৎপত্তি ও প্রকৃতি আলোচনা কর। উত্তর দেখুন

দর্শন কী এবং দর্শনের উৎপত্তি ও প্রকৃতি আলোচনা কর। উত্তর দেখুন

দর্শন কী

নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে দর্শন জ্ঞানের এমন একটি ধারা যা, মানুষের কিভাবে জীবন নির্বাহ করা উচিত (নীতিবিদ্যা); কোন ধরনের বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাদের প্রকৃতি কি (অধিবিদ্যা); প্রকৃত জ্ঞান বলতে কোন জিনিসটিকে বোঝায় এবং কারণ প্রদর্শনের সঠিক নীতিগুলো কি কি (যুক্তিবিদ্যা); এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে।

দর্শনের সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা এক কথায় অল্প কথায় প্রদান করা সম্ভব নয়। তবে ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে ব্যক্তি বিভিন্নভাবে দর্শনের সংজ্ঞা দিয়েছেন বা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসখ্যাত দার্শনিকগণ যে সকল সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা পর্যালোচনা করলে যে সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, প্রত্যেক দার্শনিকই জগৎ জীবনের ব্যাখ্যা, জগতের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক, স্রষ্টার সংগে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারােপ করেছেন।

      দর্শনের কয়েকটি প্রামাণ্য সংজ্ঞা

কয়েকজন বিখ্যাত দার্শনিক কর্তৃক প্রদত্ত দর্শনের  সংজ্ঞা এখানে উল্লেখ করা হলো—

  • গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতে, “চিরন্তন এবং বস্তুর মূল প্রকৃতির জ্ঞান অর্জন করাই দর্শনের লক্ষ্য”।
  • অ্যারিস্টটলের মতে, “আদি সত্ত্বার স্বরূপ এবং এ স্বরূপের অঙ্গীভূত যে সব বৈশিষ্ট্য তার অনুসন্ধান করে যে বিজ্ঞান তাই হলাে দর্শন”।
  • হার্বার্ট স্পেন্সার বলেন, “বিশৃঙ্খল জ্ঞান নিম্নমানের জ্ঞান। বিজ্ঞান হলাে আংশিক একীভূত জ্ঞান। বিভিন্ন বিজ্ঞানের সাধারণ সত্যগুলােকে অন্তর্নিবিষ্ট ও দৃঢ়ীকৃত করার ফলে যে সম্পূর্ণ ঐক্য বা জ্ঞান তাই হলো দর্শন”।
  • কানিংহাম বলেন, “মানুষ দার্শনিক হবে কি না, তা কোনাে প্রশ্ন নয়; প্রশ্ন হলাে ভালাে এবং মন্দ এই দুই দর্শনের মধ্যে একটিকে নির্বাচন করা”।
  • শেলিং-এর মতে, “জগৎ ঠিক কি হলে মন একে বুঝতে পারবে এবং মন ঠিক কি হলে জগৎ একে বুঝতে পারবে এটি নির্দিষ্ট করার চেষ্টাই দর্শন”।
  • আর. জে. হার্স্ট-এর মতে, “জগৎ ও মানব প্রকৃতি সম্পর্কে যেসব নির্দিষ্ট মৌলিক সমস্যা আছে তার যৌক্তিক উত্তর অনুসন্ধানই হচ্ছে দর্শন”।

উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জীবন ও জগৎকে ঘিরে উদ্ভূত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান এবং চলার পথে তার যৌক্তিক প্রতিফলন ঘটানোকে দর্শন বলে।।

দর্শনের উৎপত্তি

দর্শন শব্দটি ইংরেজি philosophy শব্দ থেকে এসেছে। ফিলোসফি শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে। গ্রিক ভাষায় φιλοσοφία (philosophía) শব্দটি দুটি শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। শব্দ দুটি হল: φίλος (ফিলোস: বন্ধু, ভালোবাসার পাত্র) এবং σοφία (সোফিয়া: প্রজ্ঞা)। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, দর্শনের সাথে মূল সম্পর্ক হচ্ছে প্রজ্ঞার, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসার। জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা এক জিনিস নয়। ঘটনা ও তথ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণা থেকে জ্ঞান লাভ করা যায়, কিন্তু দার্শনিক (যিনি দর্শন চর্চা করেন তাকেই দার্শনিক বলা হয়) কেবল তথ্যগত জ্ঞানের উপর নির্ভর করেন না। দর্শনের প্রধান কাম্য বিষয় প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার অনুসন্ধান ও চর্চার মাধ্যমেই দর্শন বিকাশ লাভ করে। পিথাগোরাস সারা জীবন প্রজ্ঞার সাধনা করেছেন, কখনও জ্ঞানের গরিমা অনুভব করেননি। এজন্য তিনি দার্শনিক হিসেবে বিদগ্ধ। দর্শনের জন্য যে প্রজ্ঞা কাম্য তার মধ্যে রয়েছে, অন্তর্দৃষ্টি, দৃষ্টিভঙ্গির অভ্রান্ততা, বিচারের ভারসাম্য ও বিশ্লেষণের সামঞ্জস্য।

বিষদ আলোচনা:

দর্শনের উৎস বা উৎপত্তিঃ যেহেতু দর্শনের কোনাে সঠিক সংজ্ঞা একবারে দেয়া সম্ভব নয়। তাই | এর উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন মতবাদ একবারে দেয়া সম্ভব হয় না। নিম্নে দর্শনের উৎস বা উৎপত্তি সম্পর্কে আলােচনা করা হল-

(১) কৌতূহলী চেতনা থেকে দর্শনঃ মানুষের মন অজানকে জানার কৌতূহলে ভরা। বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি রহস্যকে জানার কৌতুহল মানুষের আজন্মের। মানুষ যতই বিভিন্ন রহস্যকে উন্মােচন করে ততই আরাে নতুন কিছু জানার আগ্রহ তার বেড়ে যায়। তাই দেখা যায় যে, এই জ্ঞানস্পৃহার ফলেই মানুষ আজ চাঁদের দেশে পাড়ি জমিয়ে ক্ষান্ত হতে পারে নি। সে আজ অভিযান চালাচ্ছে মঙ্গল গ্রহকে আয়ত্ত করতে, আর এদিক থেকে বলা যায় যে, কৌতূহল থেকেই দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে।

(২) জগত ও জীবনের ব্যবহারিক প্রয়ােজনেই দর্শনঃ প্রকৃতির বিরাট অংশরূপেই মানুষ বিদ্যমান। জন্মের পর মানুষকে বাঁচতে হয় প্রকৃতির মাঝে। বাঁচার জন্য মানুষের প্রয়ােজন হয় প্রকৃতিকে ভালােভাবে বুঝার। প্রকৃতি থেকে প্রয়ােজনীয় বস্তুসমূহ বের করে নেবার। ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ আরম্ভ করে মানুষের স্বভাবে, মানুষের প্রয়ােজনে।

(৩) বিস্ময় থেকে দর্শনঃ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বলেন, বিস্ময় থেকে দর্শনের সৃষ্টি। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকগণ প্রকৃতিক লীলাখেলায় বিস্মিত হয়ে, প্রকৃতির ভেতর অসংখ্য জটিল সমস্যা সমাধানে তৎপর হন। অবশ্য বিস্ময়ে তাদের দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হলেও আসলে এর উৎপত্তি মানবকল্যাণে।

(৪) সংশয় হতে দর্শনঃ সংশয়কেও দর্শনের উৎপত্তির কারণ বলা হয়। অনেক দার্শনিকের মতে, বিশ্বের সবকিছুই. সংশয়পূর্ণ। তাদের মতে, চূড়ান্ত জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব। সত্যকে পাওয়া যায় না, সবকিছুতে অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। গ্রিসের সােফিস্টগণ এই দলের অন্তর্ভুক্ত। মধ্যযুগের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসকে সন্দেহে করে নবযুগের সূচনা হয়। দার্শনিক ডেকার্ট সুষ্ঠু দার্শনিক চিন্তা প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে সবকিছুকে সন্দেই করেই যাত্রা শুরু করেন। কাজেই বলা যায়, সংশয় দ্বিধাও সন্দেহ হতে দর্শনের উৎপত্তি।

(৫) উপযােগিতার ভিত্তি দর্শনের উৎসঃ প্রয়ােজনের আরেক নাম হলাে উপযােগিতা; আর এই উপযোগিতার ভিত্তিতেই দার্শনিক চিন্তা প্রসার লাভ করে। জেমস, শীলার, ডিউই প্রমুখ কোনাে কিছুর উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে একপ্রকার চিন্তা পদ্ধতির কথা বলেন। আর সেটাই হলাে দর্শন।

(৬) জ্ঞানপ্রীতিই দর্শনের উৎসঃ জ্ঞানপ্রীতি থেকেও দর্শনের উৎপত্তি হয়। মানুষ সবসময় অজানাকে জানতে চায়। তার আকাক্ষার নিবৃত্তির জন্য সে পরিবেশ ও পরিবেশের বাইরের কথা চিন্তা করে। জানতে চায় এদের ভেতরের রহস্যকে। অজানাকে জানতে চায় সে নিজের প্রয়ােজনে। অজানাকে জানলে সে সুখী ও তৃপ্তি হয়। কাজেই এই জ্ঞানপ্রীতিও মানুষের কল্যাণেই হয়। আর এ জ্ঞানপ্রীতি থেকেই দর্শনের উৎপত্তি হয়।

(৭) আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকে দর্শনঃ আধ্যাত্মিক প্রেরণা, আধ্যাত্মিক অভাব পূরণ, আত্মজ্ঞান ও আত্মশুদ্ধির জন্য মানুষ দার্শনিক কলাকৌশল গ্রহণ করে থাকে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকে দর্শনের উৎপত্তি ঘটেছে। অর্থাৎ দর্শনের মূলে রয়েছে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অভাববােধ।

(৮) জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টায় দর্শনের উৎপত্তিঃ জাগতিক দুঃখ পরিহার ও সুখলাভের প্রেরণা মানুষকে জগত ও জীবনের বড় বড় প্রশ্নের সমাধানে তৎপর করে তােলে। এ সংসারে জরা মৃত্যু, ব্যাধি অমঙ্গল, আশাভঙ্গ, জ্ঞানাচার, অবিচার অত্যাচার ইত্যাদি লেগেই আছে। তাই আধ্যাত্মিক প্রয়ােজন ছাড়াও সংসারের দুঃখ দৈন্য থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় বের করার প্রয়ােজন থেকে দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে।

(৯) জীবনে পূর্ণতা লাভের আশাই দর্শনের উৎসঃ জীবনে পূর্ণতা লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকেও দর্শনের উৎপত্তি হয়। কামনা, বাসনা, লালসা, ঈর্ষা, হিংসা, বিদ্বেষ ইদ্যাদি বৃদ্ধির দ্বারা চালিত করে সুখী, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষাও দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি ঘটায়।

(১০) সত্য উদঘাটনই দর্শনের উৎসঃ একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই জন্ম থেকে দার্শনিক। প্রত্যেক ব্যক্তিই চায় সত্যের দ্বার উদঘাটন করতে এবং সত্যকে উপলব্ধি করতে। আর এভাবেই সত্যের দ্বার উদঘাটেনের প্রয়ােজনেই দর্শনের উৎপত্তি হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন কারনে দর্শনের উৎপত্তি হলেও এর মূলে রয়েছে মানুষের প্রয়ােজন তথা মঙ্গলসাধন। দার্শনিক চিন্তা মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে ও জীবন পথে চলতে শেখায়। দর্শন মানুষের বিপদের বন্ধু ও সত্যপথ প্রদর্শক। সুতরাং মানুষ দার্শনিক চিন্তা করে এ সত্য উপলব্ধির প্রয়োজনে; জীবনকে পূর্ণভাবে ভাবতে। সত্যকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করার প্রয়ােজনেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।

দর্শন কী এবং দর্শনের উৎপত্তি ও প্রকৃতি

দর্শনের প্রকৃতি বা স্বরূপ আলোচনা করা হলঃ-

ভূমিকাঃ জীবন ও জগত সম্পর্কিত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান করাই হচ্ছে দর্শন। দৈনন্দিন জীবনে মানব মনে প্রকৃতির অপার রহস্য সম্পর্কে অজস্র জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। আর এ জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নেয় দর্শন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে এসব রহস্য ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবনের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যকেও আবিষ্কার করেছে। আর এজন্যই দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয়।

দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি বা ধরন বা বৈশিষ্টঃ মানবজীবনের উপলব্ধিজাত ফল হলাে দর্শন। জীবনের গভীর উপলব্ধি থেকে দর্শনের জন্ম। মানবজীবনের স্বরূপ, উৎপত্তি, তাৎপর্য, লক্ষ্য ও সম্ভাবনা প্রভৃতি দর্শনের প্রধান আলােচ্য বিষয়। নিম্নে দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্বন্ধে আলােচনা করা হলাে:

(১) জগৎ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দর্শনের স্বরূপঃ দর্শন জগৎ ও সত্তার প্রকত স্বরূপ ও অর্থ জানার জন্য একটা বিচারমূলক আলােচনা। দর্শন শুধু মৌলিক ধারণার পরিষ্কারকরণ ও মৌলিক বিশ্বাসের সমীক্ষা করে না, বরং সংশ্লেষণের মাধ্যমে জগত ও জীবনের একটা সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দেয়ার ও মূল্যায়নের প্রচেষ্টা চালায়।

(২) বিচার-বিশ্লেষণের চিন্তা ও যুক্তিচিন্তন পদ্ধতিঃ দর্শনের আলােচনার পদ্ধতিগুলাের মধ্যে বিচার বিশ্লেষণী বা যুক্তিচিন্তা পদ্ধতি হচ্ছে সন্তোষজনক পদ্ধতি। দর্শনের স্বরূপকে সুষ্ঠুভাবে উপলব্ধি করার জন্য সংশেষণের মাধ্যমে ধারণা গঠন দর্শনের আলােচনাভুক্ত হওয়া আবশ্যক। কোনাে সমস্যা বা সমস্যার সাথে জড়িত বিষয়াবলির বিচারমূলক সমাধান ও চিন্তামূলক অনুধ্যানেই যথার্থ দার্শনিক চিন্তা নিহিত।

(৩) আলােচ্য বিষয়ের দিক থেকে দর্শনের স্বরূপঃ কোনাে বিষয়ের স্বরূপ জানতে হলে তার আলােচ্য বিষয়ের প্রেক্ষিতে তা জানতে হয়। দর্শনের আলােচ্য বিষয় অন্যান্য বিষয়ের মতো নয়। যেমন: বিজ্ঞানের (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা) আলোচ্য বিষয় নির্দিষ্ট, কিন্তু দর্শনের আলােচ্য বিষয় নির্দিষ্ট নয়, বরং খুবই ব্যাপক। অন্যান্য বিষয়ের স্বরূপ তাদের আলোচ্য বিষয়ের প্রেক্ষিতে খুব সহজেই জানা যায় কিন্তু দর্শনের আলােচ্য বিষয় ব্যাপক হওয়ায় দর্শনের স্বরূপকে তার আলােচ্য বিষয়ের প্রেক্ষিতে সহজভাবে জানা যায় না।

(৪) সমস্যাবলির দিক থেকে দার্শনিকঃ সমস্যা বলতে এমন এক ধরনের সমস্যাকে বুঝায় যেগুলো মৌলিক ও অনন্য। দার্শনিক সমস্যাগুলাের মধ্যে ঈশ্বর, আত্মা, নৈতিকতা, মূল বিদ্যা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। দর্শন বুদ্ধি ও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে গােটা সত্তার একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। দর্শন দৈনন্দিন জীবনের ছোট খাটো সমস্যাবলি নিয়ে মাথা ঘামায় না। দর্শনের কাজ হচ্ছে জীবন ও জগতের মােলিক, অনুপম ও অনন্য প্রশ্নাবলির যৌক্তিক সমাধান।

(৫) বিজ্ঞানের দিক থেকেঃ দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের যথেষ্ট মিল রয়েছে। দর্শন যেমন বিচারমূলক, বিজ্ঞানও তেমনি পদ্ধতিমূলক। যদিও দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে মিল থাকা সত্তেও যথেষ্ট অমিল রয়েছে। দর্শন সত্তা, জগত ও জীবনের সাথে জড়িত বিভিন্ন প্রশ্নের সামগ্রিক আলােচনা ও মূল্যায়ন করে। এদিক থেকে দর্শন একদিকে বিচারমূলক, অন্যদিকে সংগঠনমূলক।

(৬) ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণের দিক থেকেঃ দর্শন ভাষার মধ্যকার দ্ব্যর্থবােধক ও অস্পষ্টতাকে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দূরীভূত করে ভাষার মধ্যে সার্বিকতা ও স্পষ্টতা আনয়ন করার চেষ্টা করে। ভিটাগনসিইন-এর মতে, দর্শনের প্রধান কাজ হচ্ছে সম্প্রসারণমূলক তৎপরতা এবং ভাষা ও চিন্তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ।

(৭) বিচার-বিবেচনার দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেঃ দর্শন নির্বিচার কোনাে কিছুই সমর্থন করে না। প্রত্যেকটি দার্শনিক মতবাদ গড়ে ওঠেছে দার্শনিক বিচার-বুদ্ধি ও তার অনুধ্যানীমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ দর্শনের মূল বাণী হচ্ছে বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে কোনাে কিছুর সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা।

(৮) বিশ্লেষণী ও সংশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেঃ দর্শন হচ্ছে বিচারবিশ্লেষনী চিন্তা ও যুক্তিসম্মত অনুসন্ধারের পদ্ধতি। দর্শনের পদ্ধতি একদিকে যেমন বিচার-বিশ্লেষণধর্মী বা বিচারমূলক অন্যদিকে তেমনি সংশ্লেষণধর্মী। বিশ্লেষণ কোনাে বস্তু বা ঘটনাকে খণ্ড-খণ্ডভাবে বিভাজ্য করে সেই বস্তু বা ঘটনার সমগ্র অংশকে উপলব্ধির চেষ্টা করে। অন্যদিকে সংশ্লেষণ প্রকৃতির খণ্ড-খণ্ড বস্তু বা ঘটনাকে একীভূত করে সমগ্রকে উপলব্ধির চেষ্টা করে।

(৯) বিস্ময় ও কৌতূহলী চেতনাঃ মানুষ জন্মগতভাবে চিন্তাশীল সত্তা, সে যখন চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে বুঝতে শেখে তখন সে প্রকৃতির অপার রহস্য দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। এই প্রাকৃতিক রহস্য উদঘাটনের জন্য সে গভীর চিন্তাভাবনা করে। আর এভাবেই মানুষের চিন্তা ভাবনার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ।

(১০) কতিপয় মৌলিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাঃ দর্শন হচ্ছে মানুষ এবং মানব জগত সম্পর্কে কতিপয় মৌলিক সমস্যার সমাধানের বৌদ্ধিক অনুসন্ধান। যেমন: আত্মা কী? আদি সত্তা কী? মূল্য কী ? ইচ্ছার স্বাধীনতা কী? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরদানের প্রচেষ্টা দর্শনে লক্ষ্য করা যায়।

(১১) বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যবর্তী প্রদেশঃ দর্শন হচ্ছে ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী প্রদেশ। ধর্মতত্ত্বের আলােচ্য বিষয়কে বিজ্ঞানের আলােকে যাচাই করাই দর্শনের প্রধান কাজ।

(১২) দর্শনের পদ্ধতিঃ দার্শনিকেরা তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেমন: কর্তৃত্বমূলক, সত্তামূলক অনুধ্যানমূলক পদ্ধতি ইত্যাদি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্বজগতের এমন কোনাে দিক নেই যা দর্শনের আওতায় পড়ে না। অর্থাৎ এর প্রকৃতি অপরিমেয়। দর্শন বাস্তবের সাহায্যে অবাস্তবের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ন পদ্ধতির উদ্ভাবন ও আলোচনা করে। দার্শনিক কেয়ার্ড বলেন, মানব অভিজ্ঞতার এমন কোন দিক নেই এবং সমগ্র জগত সত্তার মধ্যে এমন কিছু নেই যা দর্শন রাজ্যের বাইরে পড়ে বা যার দিকে দার্শনিক অনুসন্ধান প্রসারিত হয় না।

দর্শন কী এবং দর্শনের উৎপত্তি ও প্রকৃতি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top