বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের অজানা অধ্যায়!

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য – এর সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের অজানা অধ্যায়!

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য হলো বাঙালি অধ্যুষিত ভারতের দুইটি প্রদেশের একটি আর আরেকটি প্রদেশ হলো পশ্চিমবঙ্গ । বিশ্বের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্র বাংলাদেশ এর সাথে বাঙালি অধ্যুষিত অন্যান্য অঞ্চল গুলোর যোগাযোগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত অত্যন্ত আশ্চর্য হলেও সত্যি, পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলেও ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ- ই নাই বল্লেই চলে।

ত্রিপুরার কথা বলতে যাবো আর মাণিক্য রাজবংশের কথা আসবে না, এমনটা ভাবাও অসম্ভব। সেই ১৪৫০ এর দশক থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ পাঁচশ বছর ত্রিপুরা শাসন করে আজকের ত্রিপুরাকে গড়ে তুলেছে এই রাজবংশ। আর ত্রিপুরায় ইসলামের ঐতিহাসিক সম্পর্কও এই রাজবংশের সাথেই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।

ত্রিপুরা রাজ্যটি বলতে গেলে বাংলাদেশের কোলের ভিতরেই। খাগড়াছড়ি এবং সিলেটের মাঝখানে বাংলাদেশের ম্যাপে যে ফাঁকা অংশটি রয়েছেই সেটিই ত্রিপুরা। বাংলাদেশের কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর জেলা ইতিহাসের নানা সময়ে ত্রিপুরার সাথে যুক্ত ছিলো। অর্থাৎ মাত্র শত বছর আগেও বাংলাদেশের কাছের ত্রিপুরা আজ মনস্তাত্ত্বিকভাবেও অনেক দূরে সরে গেছে বাংলাদেশ থেকে, আর কাঁটাতারের শক্ত বেড়া তো রয়েছেই।

মাণিক্য রাজবংশের রাজারা ১৪৫০ সালের আরো আগে থেকেই ত্রিপুরার শাসন ক্ষমতায় ছিলো। কিন্তু তখন তাদের উপাধি ছিলো ” ফা ” ( মাণিক্য উপাধি কেউ কেউ ধারণ করলেও সেটা একক আইডেন্টিটি ছিলো না )। পনেরোশ শতকে একজন ফা বংশীয় যুবরাজ ছিলেন ” রত্ন ফা “। বাল্যকালেই রত্নফা কে তার পিতা রাজা ডাঙ্গর ফা বাংলার সুলতানের রাজদরবারে প্রেরণ করেন শিক্ষালাভের জন্য।

বৃদ্ধ বয়সে রাজা ডাঙ্গর ফা তার ১৮ জন ছেলের মধ্যে রত্ন ফা ব্যাতীত আর সবাইকে রাজ্য ভাগ করে দেন। আর এতে ক্ষুব্ধ হয় রত্ন ফা। আবার এদিকে ১৪৫৯ সাল থেকে ১৪৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলার সুলতান ছিলেন বিখ্যাত ইলিয়াস শাহী বংশের শাসক রুকন উদ্দীন বারবাক শাহ।

সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহের সাহায্যে রাজা রত্ন ফা ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। সুলতানের সাহায্যে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রাজা রত্ন ফা কৃতজ্ঞতা জানাতে মূল্যবান একটি ” মাণিক ” উপহার দেয় সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহকে।

মূল্যবান “মাণিক” উপহার পেয়ে সুলতান খুবই খুশি হন রাজা রত্ন ফা এর উপর। তিনি তখন রাজা রত্ন ফা কে মাণিক্য উপাধি প্রদান করেন। আর সেই থেকে ত্রিপুরা রাজাদের পদবি ” ফা ” থেকে পরিবর্তিত হয়ে “মাণিক্য ” হয়ে উঠে। এর আগে ত্রিপুরা রাজারা মাঝেমধ্যে মাণিক্য উপাধি ধারণ করলেও মূল উপাধি ছিলো ফা। কিন্তু সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহ কর্তৃক ” মাণিক্য ” উপাধি দেওয়ার পর বাকিসব উপাধি বাদ দিয়ে ত্রিপুরা রাজারা শুধুমাত্র এই উপাধিই চালু রেখেছে পরবর্তী সময়ে।

[ তথ্যসূত্রঃ ত্রিপুরা রাজ্যের জন্য ভারত সরকার কর্তৃক প্রণীত নবম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের ১৮২ পৃঃ ]

অর্থাৎ যে মাণিক্য রাজবংশ ব্যতীত ত্রিপুরার ইতিহাস লেখা অসম্ভব, আবার সেই মাণিক্য রাজবংশের ইতিহাস বাঙলার সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহের কীর্তি ছাড়া লেখা অসম্ভব!

সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহ একজন ধার্মিক, বিদ্বান এবং অসাম্প্রদায়িক শাসক ছিলেন। তিনি মুসলিম ও হিন্দু পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার সময়ে জয়নুদ্দিন তার রাসুল বিজয়  কাব্য রচনা করেন। রায়মুকুল ব্রশপতি মিশ্র, মালাধর বসু, কৃত্তিবাস ও কুলাধর সেসময়কার অগ্রগণ্য হিন্দু পণ্ডিত ছিলেন। তার সময়েই কৃত্তিবাস বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন।

সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহের এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তার বন্ধু রত্ন মাণিক্যের মনোজগতেও প্রভাব ফেলে। আর তাইতো দেখা যায়, রত্নমাণিক্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের ৫০০ বছরের শাসনামলে ত্রিপুরা রাজ্যের কোথাও কখনো হিন্দু মুসলিম সংঘাত হয়নি।

শাসন পরিচালনার সময় রত্ন মাণিক্য দক্ষ প্রশাসক এবং ব্যাবসায়ী শ্রেণীর অভাব বোধ করছিলেন। তাই তিনি তার বন্ধু সুলতান রুকনউদ্দীনকে অনুরোধ করেন, বাংলা থেকে কিছু বাঙালি (বিশেষত হিন্দু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়) জনগোষ্ঠীকে ত্রিপুরায় প্রেরণ করতে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় চার হাজার বাঙালি পরিবারকে ত্রিপুরায় প্রেরণ করেন সুলতান। যারা পরবর্তীতে ত্রিপুরায় রাজ প্রশাসন গড়ে তুলতে এবং কৃষি কাজের প্রসার ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ইতিহাসের মোহনায় ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশ অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত।

২…

ত্রিপুরা রাজের সাথে বাংলার মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর সংঘর্ষ!

রুকনউদ্দীন বারবাক শাহের মাধ্যমে ত্রিপুরারাজ এবং বাংলার মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি হলেও রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপটে অঞ্চল দুইটি সেসময় বারেবারে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিশেষ করে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের দখল নিয়ে বাংলার শাসকদের সাথে ত্রিপুরারাজের বিরোধ লেগেই থাকতো।

চট্টগ্রাম নিয়ে বিরোধ!

১৫১৩ সালের দিকে বাংলায় আলাউদ্দিন হুসেইন শাহের শাসনামলে ত্রিপুরারাজ প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম দখল করে। যদিও এর কয়েক বছর ত্রিপুরারাজ থেকে চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করা হয়। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহের পুত্র সুলতান নশরত শাহ চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করেন। ( চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই সুলতান নশরত শাহের স্মৃতিবিজড়িত ফতেয়াবাদ, নসরত শাহ মসজিদ, নসরত শাহ বড় >বড দিঘী অবস্থিত।) 

ত্রিপুরা এবং বাংলার এই বিবাদের সুযোগ নিয়ে পাশ্ববর্তী আরাকান রাজ্য শক্তি সঞ্চয় করে ১৫৫০ এর দিকে চট্টগ্রামের দখল নিয়ে নেয় ( ততদিনে অবশ্য হোসেন শাহী বংশকে হটিয়ে বাংলার সিংহাসনে ছিলো শের শাহের বংশধরেরা)। অর্থাৎ ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের চট্টগ্রাম বিজয়ের ( ১৩৪০ সালে চট্টগ্রাম বিজয় হয়) প্রায় ২০০ বছর পর চট্টগ্রাম বাংলার হাতছাড়া হয়।

কুমিল্লা এবং নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে বিরোধ!

কুমিল্লা এবং নোয়াখালী অঞ্চলের বেশিরভাগই তৎকালে ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিলো। বাংলার শাসকরা প্রায় সময় এগুলো দখলে নেওয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসকরা কখনোই পূর্ণরূপে কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলের শাসনভার করায়ত্ত করতে পারেনি। যদিও নিত্য সংঘর্ষের কারণে ত্রিপুরা রাজ্যের দখলও দুর্বল হতে থাকে কুমিল্লা অঞ্চলে। তারা আস্তে আস্তে পার্বত্য ত্রিপুরার দিকে চলে যেতে থাকে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সর্বপ্রথম ভাটি বাংলা মোগলদের করায়ত্ত হয়। এরপর স্বাভাবিকভাবেই সম্রাট জাহাঙ্গীর ত্রিপুরার দিকে নজর দেয়। মোগলরা অবশ্য সরাসরি ত্রিপুরার শাসনভার নিতে চায়নি। কারণ ত্রিপুরার  দুর্গম অঞ্চল এবং আবহাওয়ায় মোগলরা টিকতে পারে নি।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

তাই ত্রিপুরাকে করদ রাজ্য হিসেবেই নিজেদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখে মোগল বাদশাহরা। ত্রিপুরা থেকে মোঘলদের কর সংগ্রহ এবং তা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলোঃ

ক) যশোধর মাণিক্যের আমলে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে হস্তী চেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু যশোধর মাণিক্য তা প্রদানে অনাগ্রহ দেখান। সম্রাট জাহাঙ্গীর তখন মোগল ফৌজসহ ফতেহজঙ্গকে পাঠালেন। যুদ্ধে দিল্লীর সম্রাটের বাহিনীর নিকট ত্রিপুরা রাজার পরাজয় ঘটলে মোগলরা মেহেরকুলে (কুমিল্লা) স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। মেহেরকুলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে জমিদারও নিয়োগ করে ফেলেন মোগলরা।

খ) সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের আমলের শুরুতে ত্রিপুরার রাজা ছিলেন গোবিন্দ মাণিক্য। গোবিন্দ মাণিক্য নিয়মিত সম্রাটকে কর প্রদান করতেন।

বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শাসনের মাঝামাঝি সময়ে ত্রিপুরার রাজা ছিলেন দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্য। সেসময় বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানের সাথে কর ইস্যুতে রত্ন মাণিক্যের বিরোধ হয়। শায়েস্তা খাঁ প্রতিশোধ হিসেবে রত্ন মাণিক্যকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং নরেন্দ্র মাণিক্যকে ( দ্বারকা) ত্রিপুরার ক্ষমতায় বসান। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সেসময়কার ত্রিপুরার রাজক্ষমতা বাংলা থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতো।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

গ) মোগল বাদশাহ শাহ আমলের সময় বাংলার নবাব সুজাউদ্দৌলা ১৭৩২ সালে ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। তিনি ত্রিপুরা রাজা দ্বিতীয় ধর্ম মাণিক্য কে পরাজিত করেন এবং জগৎরাম নামক আরেকজন যুবরাজকে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসান।

নবাব সুজাউদ্দৌলা এসময় সম্পূর্ণ কুমিল্লা এবং নোয়াখালী অঞ্চল বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি এই অঞ্চলের নামকরণ করেন ” চাকলা রোশনাবাদ “। আর সে থেকেই নোয়াখালী, কুমিল্লা হয়ে উঠলো বাংলার স্থায়ী অংশ।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সেই সুলতানি আমলের সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহ থেকে শুরু করে মোগল বাদশাহদের আমল পর্যন্ত পুরা সময়ই ত্রিপুরা বাংলার করদরাজ্য ছিলো। আর বৃহৎ শক্তির অধিকারী হওয়ায় বাংলা স্বাভাবিকভাবেই ত্রিপুরার উপর আধিপত্য বজায় রাখতো। কিন্তু বাংলার শাসকেরা কখনোই ত্রিপুরার স্বাধীনতা হরণ বা সংস্কৃতি বিলীন করার চেষ্টা চালায়নি।

ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে ত্রিপুরা রাজের সাথে মাঝেমধ্যেই বাংলার সুলতান, নবাবদের সংঘর্ষ হতো। কিন্তু সেসব সংঘর্ষে জিতার পরেও কখনোই বাংলার শাসকেরা ত্রিপুরার সিংহাসন দখল করেননি। বেশি হলে তারা অন্য আরেক ত্রিপুরা যুবরাজকে সিংহাসনে বসিয়ে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

৩…

মোগল শাহজাদা শাহ সুজার স্মরণে ত্রিপুরা রাজার মসজিদ নির্মাণ!

ত্রিপুরা বাংলা সম্পর্কের ঐতিহাসিক মাইলফলক হলো বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত শাহ সুজা মসজিদটি।

মোগল বাদশাহ শাহজাহানের পুত্র এবং বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ভাই শাহ সুজা ১৬৩৯ সাল থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। এসময় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তার সাথে ত্রিপুরা রাজাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে।

ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের সাথেও শাহ সুজার অম্ল মধুর সম্পর্ক বজায় ছিলো। তাদের এই সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়, যখন এই দুই শাসক ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আরাকানে গিয়ে উঠেন। এককালের প্রভাবশালী বাংলা এবং ত্রিপুরার এই দুই শাসক ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রাজ্যহারা হন একইসাথে এবং আশ্রয়স্থল হিসেবে উভয়ই বেঁচে নেন পাশ্ববর্তী আরাকান রাজ্যকে।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

সুবাদার শাহ সুজা একদিকে তার ভাই আওরঙ্গজেব আলমগীরের সাথে সিংহাসন দখলের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অপরদিকে ত্রিপুরারাজ গোবিন্দ মাণিক্য তার বৈমাত্রেয় ভাই নক্ষত্র মাণিক্যের কূটকৌশলে সিংহাসন হারিয়ে একসময় আরাকানে পৌঁছান। সিংহাসনচ্যুত এই দুই শাসকের মাঝে এইসময় খুবই ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, আরাকানে যুবরাজ শাহ সুজা নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হন। অপরদিকে গোবিন্দ্য মাণিক্য একটাসময় পর আবার ত্রিপুরার সিংহাসনে আরোহন করেন। পুনরায় রাজা হবার পর রাজা গোবিন্দ্য মাণিক্য তার প্রিয় বন্ধু শাহ সুজার স্মরণে তখন কুমিল্লায় নির্মাণ করেন একটি মসজিদ।

অবশ্য কারো কারো দাবি মতে, মসজিদটি শাহ সুজার নিয়োগকৃত কোনো কর্মকর্তা দ্বারা তারই শাসনামলে তৈরি। কিন্তু শাহ সুজার শাসনামলে কুমিল্লার বেশিরভাগ অঞ্চলে মোঘল শাসনের দৃঢ় ভিত্তি না থাকায় এই দাবিটা অগ্রহণযোগ্যই মনে হয়। আর তাছাড়া ত্রিপুরা রাজবংশের বর্তমান রাজা প্রদ্যোত বিক্রম মাণিক্য ও কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, শাহজাদা শাহ সুজার জন্যই মসজিদ নির্মাণ করেন প্রদ্যোতের পূর্ব পুরুষেরা।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

৪…

ত্রিপুরা কি বাংলাদেশে যোগদান করতে পারতো!

একসময় মোগল শাসনের যবনিকাপাত ঘটে। ভারত জুড়ে গড়ে উঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ত্রিপুরাকে পুরোপুরি দখল না করে করদ রাজ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়।

মোগল আমলেই সমতল ত্রিপুরা তথা কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল বাংলার অধিভুক্ত হয়।”চাকলা রোশনাবাদ” নামে এর নামকরণ করে মোগলরা এখানে জমিদারি প্রথা চালু করে। ব্রিটিশ আমলেও এটি বজায় ছিলো। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলেও কুমিল্লা এবং নোয়াখালী অঞ্চল ত্রিপুরা থেকে পৃথক ছিলো এবং বাংলার অংশ ছিলো। নবাব সুজাউদ্দৌলার মাধ্যমে বাংলার যুক্ত হওয়া কুমিল্লা আর নোয়াখালীকে আর কখনো ফিরে পাইনি ত্রিপুরা।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয় ভারতবর্ষ। এই সময় দেশীয় রাজ্যগুলোর এখতিয়ার ছিলো নিজের ইচ্ছমতো ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান করা অথবা স্বাধীন থাকার। ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য চেয়েছিলেন ভারতে যোগদান করতে। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার অল্প কিছুকাল আগে তিনি মারা যান। এরপর কীর্তি বিক্রম মাণিক্য ক্ষমতায় বসলেও বয়স কম হওয়ায় তার মা মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী ত্রিপুরার ক্ষমতার মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেন।

ইতিহাসের আলোকে দেখা যায়, ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রায় ২ বছর পর ত্রিপুরা ভারতে যোগদান করে ১৯৪৯ সালে। কিন্তু ত্রিপুরার এত দেরিতে ভারতে যোগদান করার কারণ কি? বিভিন্ন তথ্যমতে, ত্রিপুরার তৎকালীন ডি ফ্যাক্টো শাসক মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী চেয়েছিলেন ভারতের সাথে যোগ না দিয়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ( আজকের বাংলাদেশ) সাথে যোগ দিতে।

মহারাণীর বাংলাদেশে ( তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) যোগদান করার ইচ্ছে নিয়ে অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন আলাপ আছে। ভারতের অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যু বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত কখনোই এই ব্যাপারে আলাপ তুলবে না। কিন্তু ২০১৪ সালে ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার দৃঢ়তার সাথে দাবি তোলেন যে, মহারাণী ভারতের বদলে পূর্ববঙ্গেই যোগদানে ইচ্ছুক ছিলো। …

ত্রিপুরাকে দুই দশক শাসন করা বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের এমন দাবি তাই ফেলনার বিষয় নয়। মানিক সরকারের এমন দাবি সত্যি হলে এটা বলা যায় যে, তৎকালীন অদক্ষ পূর্ববঙ্গীয় শাসকগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ ত্রিপুরাকে হারিয়েছে চিরতরে।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

অবশ্য মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী চাইলেও ত্রিপুরাকে পূর্ব বঙ্গের সাথে যুক্ত করতে পারতেন কিনা, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কেননা সেসময় বিহারে দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালী অঞ্চলে দাঙ্গা সৃষ্টি হলে বিরাট সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠী ত্রিপুরায় মাইগ্রেন্ট হন। স্বাভাবিকভাবেই তখন হিন্দু প্রধান রাজ্য ত্রিপুরা এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ গড়ে উঠে। এই বিরোধ টপকিয়ে বাংলাভাষী এই দুই অঞ্চলকে এক করার মতো যোগ্য কোনো নেতৃত্ব তখন ছিলো না। তাই চোখে দেখা দূরত্বের আগরতলা আজ হয়ে গেলো আমাদের জন্য অচিন এক জায়গা।

৫…

কাজী নজরুল ইসলাম! বাংলাদেশের জাতীয় কবি ত্রিপুরায় যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণীয়!

বাঙালি রাষ্ট্র বাংলাদেশ, বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ কিংবা আসাম কোথাও কিন্তু নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে সরকারি ছুটি নাই। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, ত্রিপুরা রাজ্য বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে সরকারি ছুটি পালন করে আসছে সুদীর্ঘ সময় ধরে।

ত্রিপুরায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণীয়। তার জন্মদিন উপলক্ষেও স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা হয়। ত্রিপুরা রাজার সাথে রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। ত্রিপুরা রাজাদের আমন্ত্রণে বিশ্বকবি সর্বমোট ৭ বার ত্রিপুরা ভ্রমণে আসেন।

বাংলাভাষী ত্রিপুরা রাজ্য

ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য এবং মোগল শাহজাদা শাহ সুজার বন্ধুত্ব নিয়ে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এই রাজা গোবিন্দ মাণিক্যকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তার অনবদ্য “রাজর্ষি ” উপন্যাসটি।

অপরদিকে কাজী নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী, সাম্যবাদী মানসিকতার কারণে ত্রিপুরার সন্তান না হয়েও ত্রিপুরাবাসীর কাছে পরম শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ যা বলা যায়, ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক টা হলো অনেকটা সাগরের মাঝে পথহারা ব্যক্তির কাছে থাকা বিশাল পানির মজুদের মতো। সাগরে দিক হারিয়ে অজানায় ভাসতে থাকা ব্যক্তির চারিপাশ পানি দ্বারা পূর্ণ হলেও খাওয়ার মতো এক ফোঁটা পানিও পায় না সেই মানুষটি। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত হলেও ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের বর্তমানে নেই তেমন যোগাযোগ!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top