খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস- History of Rashidun Caliphate

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস- History of Rashidun Caliphate

খুলাফায়ে রাশেদীনের শাব্দিক অর্থ ন্যায়নিষ্ঠ , ন্যায়পরায়ণ, সঠিকভাবে পথনির্দেশপ্রাপ্ত খলিফা। ইসলামের সর্বশেষ রাসুল নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর পর মুসলিম বিশ্ব শাসনকারী চারজনকে (মতান্তরে পাঁচজন) খুলাফায়ে রাশেদীন বলা হয়। তাঁরা নবী করিম (সঃ) এর সহচর ছিলেন এবং তাঁর ইন্তেকালের পর ইসলামীক বিশ্বের নেতৃত্ব দেন। পক্ষান্তরে উক্ত পাঁচজন হলেন:

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস

হযরত আবু বকর (রাঃ) [১] (৬৩২৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ)

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) [২] (৬৩৪৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)

হযরত উসমান ইবন আফফান(রাঃ) [৩] (৬৪৪৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ)

হযরত ʿআলী ইবন ʾআবী তালিব(রাঃ)[৪] (৬৫৬৬৬১ খ্রিস্টাব্দ)

হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ)[ক] (৬৬১ খ্রিস্টাব্দ)

খুলাফায়ে রাশেদীন

৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে খুলাফায়ে রাশেদীন-এর আওতায় ৩.৬ মিলিয়ন বর্গমাইল এলাকা ছিল। এরপর অবশ্য আরেকটি মুসলমান খলিফার রাজ্য বড় হয়ে ওঠে। তবে শুধু ভূমি ব্যবহার করে গড়ে ওঠা এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। | ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাহাবীদের মধ্যে চার জনকে খুলাফায়ে রাশেদীন বলা হয়। তাঁরা পরবর্তীতে এ খেলাফতের নেতৃত্ব দেন। এই চারজন খলিফা হলেন হযরত আবু বকর (রাঃ) (৬৩২-৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খলিফা ছিলেন), হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ খলিফা ছিলেন), হযরত ওসমান (রাঃ) (৬৪৪-৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ খলিফা ছিলেন) ও হযরত আলী (রাঃ) (৬৫৬-৬৬১ খ্রিস্টাব্দ খলিফা ছিলেন)।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস- History of Rashidun Caliphate

খিলাফত সম্পর্কে খুলাফায়ে রাশেদিন এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবিদের সর্বসম্মত অভিমত ছিল, খিলাফত একটি নির্বাচন ভিত্তিক পদমর্যাদা। সকলের নির্বাচনের মাধ্যমেই খলিফা নির্বাচিত হয়। মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শ এবং তাঁদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমেই তা কায়েম করতে হবে। বংশানুক্রমিকভাবে বা বল প্রয়োগের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া কিংবা নেতৃত্ব দেয়া তাদের মতে খিলাফত নয়, বরং তা রাজতন্ত্র।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস

ইসলামের এই খিলাফত ব্যবস্থা সর্বজনীন। আল্লাহর এই প্রতিনিধিত্বের অধিকার বিশেষ কোনো ব্যক্তি, পরিবার কিংবা বিশেষ কোনো শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত বা নির্দিষ্ট নয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী এবং তাঁদের বিধান ও আইন মান্যকারী সব মানুষই আল্লাহর দেয়া এই প্রতিনিধিত্বের সমান অধিকারী। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল আল্লাহ তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। ‘(সূরা আন নূর : ৫৫)।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস- History of Rashidun Caliphate

ইসলামে নবুওয়াতের পদমর্যাদার পর এই খিলাফত ব্যবস্থাই এ পদটি পবিত্র দায়িত্বপূর্ণ এবং সর্বাধিক মর্যাদা সম্পন্ন পদ। বস্তুত ইসলামে খিলাফতের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সর্বাত্মক। যাবতীয় বৈষয়িক, ধর্মীয় ও তমদ্দুনিক উদ্দেশ্যের পূর্ণতা বিধান এরই ভিত্তিতে হয়ে থাকে। হাদিস ও কুরআন হতে খলিফার বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা সম্পর্কে যা জানা যায়, ঐ আলোকে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ‘খুলাফায়ে রাশেদিনই ছিলেন মুসলিম জাহানের খলিফা হওয়ার সর্বাধিক উপযুক্ত। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত গুণ ও বৈশিষ্ট্য তাঁদের মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল।

খুলাফায়ে রাশেদিনের মর্যাদা

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস- History of Rashidun Caliphate

মহান আল্লাহ মানব জাতির হেদায়াতের লক্ষ্যে পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা: তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর আনীত আদর্শ দ্বারা জগতের শ্রেষ্ঠ একদল মানুষকে বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে পেরেছিলেন। ‘খুলাফায়ে রাশেদিন’ অর্থাৎ চারজন সাহাবি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মহানবী সা:-এর পর এই চারজন সাহাবির বিশেষ মর্যাদা সংরক্ষিত। তাঁদের সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে অনেকগুলো পবিত্র বাণী উদ্ধৃত করা হলো।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস

* আবদুল্লাহ ইবন ‘উমর রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর জামানায় আমরা লোকদের মধ্যে পরস্পরকে প্রাধান্য দিতাম। আমরা হজরত আবু বকর রা:কে সবার উপরে প্রাধান্য দিতাম, তারপর হজরত ‘উমর ইবনুল খাত্তাব রা:কে এবং অতঃপর হজরত ‘উসমান ইবনে আফফান রা:কে। (সহিহ বুখারি)।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস

* আনাস ইবন মালিক রা: বলেন, ‘নবী সা: একদা হজরত আবু বকর, হজরত ‘উমর ও হজরত ‘উসমান রা:-সহ উহুদ পাহাড়ে আরোহণ করলে পাহাড় তাঁদের নিয়ে (আনন্দে) দুলতে থাকে। তখন নবী সা: বললেন, ‘হে উহুদ! স্থির থাক। কেননা তোমার উপরে একজন নবী, একজন সিদ্দিক ও দু’জন শহীদ আছে।’ (সহিহ বুখারি)।

* হজরত উকবা ইবন আমের রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘আমার পরে যদি কেউ নবী হতো তাহলে উমর ইবনুল খাত্তাবই নবী হতো’ (তিরমিজি)।

* হজরত ‘আলী রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘হজরত আবু বকর এবং হজরত ‘উমর রা: নবী-রাসূলগণ ছাড়া পৃথিবীর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত জান্নাতবাসী বয়স্ক লোকদের নেতা হবেন।’ (জামে তিরমিজি)।

* হজরত সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ‘আলী রা:কে লক্ষ্য করে বলেছেন, হজরত মূসা আ:-এর কাছে হজরত হারুন আ:-এর যে মর্যাদা ছিল, তুমিও আমার কাছে সেই মর্যাদায় অভিষিক্ত। তবে আমার পরে কোনো নবী নেই।’ (সহিহ বুখারি)।

খিলাফতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস- History of Rashidun Caliphate

খিলাফতে রাশেদার ৩০ বছর শাসনকাল (৬৩২-৬৬১ খ্রি.) পর্যালোচনা করলে যে বৈশিষ্ট্যগুলো মানবজাতিকে বিমোহিত করে তা হচ্ছে :

(ক) খুলাফায়ে রাশেদিনের আমল বিশ্বনবী সা:-এর পবিত্র জীবনাদর্শ উজ্জ্বল প্রদীপে পরিণত হয়েছিল এবং তা সমগ্র পরিমণ্ডলকে নির্মল উদ্ভাসিত করে রেখেছিল। খলিফাগণের প্রতিটি চিন্তায় ও কাজে তার গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল। চারজন খলিফাই মহানবী সা:-এর বিশিষ্ট সাহাবি ও একান্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁরা ছিলেন তাঁর সর্বাপেক্ষা পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত এবং তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণ। হজরত ‘আলী রা: ছাড়া আর তিনজন খলিফাই মহানবী সা:-এর দ্বিতীয় কর্মকেন্দ্র ও শেষ শয্যাস্থল মদিনায় রাজধানী রেখেই খিলাফতের প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছিলেন।

(খ) তাঁরা ছিলেন মুসলিম উম্মাহর একমাত্র সর্বাপেক্ষা অধিক আস্থাভাজন। আধুনিককালের পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন হলেও তখন কেবল তাঁরাই যে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হতেন তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস

(গ) খিলাফতে রাশেদার আমলে আইন প্রণয়নের ভিত্তি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ ও নবিজীর আদর্শ। যে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশ পাওয়া যেত না, সে বিষয়ে ইজতিহাদ করে সুষ্ঠু সমাধান ও ন্যায় বের করার চেষ্টা করা হতো এবং এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর পারদর্শী প্রত্যেক মানুষকেই মতামত দেয়ার সমান অধিকার ছিল।

(ঘ) খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলে জাঁকজমক ও শান-শওকতের ,রাজকীয় ভোগবিলাসের, কোনো জায়গা ছিল না। খলিফাগণ একান্তই সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের খলিফাদের কোনো কোনো দেহরক্ষী বা নিরাপত্তা প্রহরী ছিল না। লোকজন যখন ইচ্ছা খুলাফায়ে রাশেদেীনের খলিফাদের কাছে যেতে পারত।

(ঙ) খুলাফায়ে রাশেদিন বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রের সরকারি কোষাগারকে জাতীয় সম্পদ ও আমানতের ধন মনে করতেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মঞ্জুরি ছাড়া নিজের জন্য একটি অর্থও কেউ ব্যয় করতেন না।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস

(চ) খুলাফায়ে রাশেদীনের খলিফারা তাদেরকে নিজেদেরকে জনগণের খাদিম মনে করতেন। কোনো ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজেদেরকে জনসাধারণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধারণা করতেন না এটাই ছিলো তাদের আদর্শ। তাঁরা কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই জননেতা ছিলেন না, নামাজ ও হজ প্রভৃতি ধর্মীয় ব্যাপারেও যথারীতি তাঁরাই নেতৃত্ব দিতেন। তারা ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধীকারি।

মোটকথা, ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ এবং ধর্মীয় কাজ ও রাষ্ট্রীয় কাজে দ্বৈতবাদ যেমন আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, অনুরূপভাবে এতদুভয়ের একত্রীকরণ ও সর্বতোভাবে একমুখীকরণই ছিল খিলাফতে রাশেদার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

খুলাফায়ে রাশেদীন এর ইতিহাস || ইসলামের ইতিহাস

হজরত আবু বকর রা: খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর জাতির উদ্দেশে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন তাতে তিনি বলেন, ‘হে মানুষ! আমি অপনাদের খলিফা নির্বাচিত হয়েছি, অথচ আমি আপনাদের কারো থেকে অপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি নই। আমি ভালো কাজ করলে আপনারা আমার সহযোগিতা করবেন এবং বিচ্যুত হলে সহজ সরল পথে দাঁড় করিয়ে দেবেন। সত্য হলো আমানত এবং মিথ্যা হলো খিয়ানত। আপনাদের মধ্যকার দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে সবল যতক্ষণ আমি তার অধিকার পৌঁছে দিতে না পারি। আর আপনাদের মধ্যকার সবল ব্যক্তি আমার কাছে দুর্বল যতক্ষণ আমি তার কাছ থেকে অপরের অধিকার আদায় করে দিতে পারি। আপনাদের কেউ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজ ছেড়ে দেবেন না, এরূপ করলে সে জাতিকে আল্লাহ অপছন্দ করবেন। কোনো সম্প্রদায়ের ভেতরে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো যাবে না, তাহলে সবার ওপর আল্লাহ বিপদ চাপিয়ে দেবেন। আমি যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করি ততক্ষণ আমার আনুগত্য করবেন। আর যদি আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হই, তবে আমার আনুগত্যের প্রয়োজন নেই। আপনারা নামাজ আদায় করবেন। আল্লাহ আপনাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন।’

আমাদের উচিত তাদের আদর্শে আদর্শবান হওয়া।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top