তুরস্ক ড্রোন সাফল্যে এগিয়ে যাচ্ছে

ড্রোন সাফল্যে এগিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক- সিরাজুর রহমান

ড্রোন সাফল্যে এগিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক– সিরাজুর রহমান ।। তুরস্ক সাম্প্রতিক সময়ে তাদের একেবারে নিজস্ব এবং নতুন প্রযুক্তির বায়রাক্তার আকিঞ্চি হেভী কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) রপ্তানির প্রাথমিক চুক্তি সম্পন্ন করেছে। মুলত তুরস্কের কমব্যাট ড্রোন উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান বায়কার মাকিনা বায়রাক্তার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোনের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা এবং ব্যাপক সফলতার উপর ভিত্তি করে আরো অত্যাধুনিক এবং নতুন মাত্রার কিছু গোপন উচ্চ প্রযুক্তি সমন্বয়ে হেভি বায়রাক্তার আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) সার্ভিসে এনেছে। খুব সম্ভবত ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোন এক বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সাথে আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোনের রপ্তানির প্রাথমিক প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করলেও কোন দেশের কাছে এবং কতটি ইউনিট রপ্তানি করা হচ্ছে তা এখনো পর্যন্ত কিন্তু প্রকাশ করা হয়নি।

তুরস্ক বিগত এক দশক থেকে ডেডিকেটেড বায়রাক্তার আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও পরীক্ষা করলেও এর প্রথম সফল ফ্লাইট সম্পন্ন করে ২০১৯ সালের ৬ই ডিসেম্বর। সকল প্রকার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, ব্যাপক গবেষণা ও পরীক্ষা শেষে তুরস্কের হেভি ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বায়কার মাকিনা তাদের হাইলী এডভান্স বায়রাক্তার আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) ২০২১ সালের ২৯শে আগস্ট থেকে তুর্কী সামরিক বাহিনীর হাতে চূড়ান্তভাবে তুলে দেয়। এ পর্যন্ত মোট ৯টি আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোন ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ৩টি প্রটোটাইপ কপি এবং ৬টি সিরিয়াল প্রডাকশন। বর্তমানে তুরস্কের বিমান বাহিনী ৩টি, সেনা বাহিনী ১টি এবং তুর্কী ন্যাশনাল ইন্টালিজেন্স অর্গানাইজেশন ১টি করে লং রেঞ্জের ডেডিকেটেড আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) অপারেট করে।  

তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার আকিঞ্চি ড্রোন হচ্ছে মুলত হাই অল্টিটিউট এণ্ড লং ইন্ডিউরেন্স কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি)। যেটিকে মুলত আকাশের অত্যন্ত উচ্চতায় উড্ডয়নের পাশাপাশি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আকাশে তার কমব্যাট মিশন পরিচালনা করার বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। তাছাড়া এটি হচ্ছে বিশ্বে সার্ভিসে থাকা অন্যতম বৃহৎ আকৃতির কমব্যাট ড্রোনগুলোর মধ্যে একটি। যা কিনা এয়ার লঞ্চড ক্রুজ মিসাইল বহন ও হামলার করতে সক্ষম এবং এমনকি এটি থেকে স্বল্প সক্ষমতা ও ওজনের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড সমৃদ্ধ ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করা সম্ভব হবে বলে আগেই জানানো হয়েছে।

লং রেঞ্জের আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোনের (ইউসিএভি) দৈর্ঘ্য ১২.৫ মিটার, দুই ডানার মাঝের দূরত্ব ২০ মিটার এবং উচ্চতা ৪.১০ মিটার। এর ম্যাক্সিমাম টেকঅফ ওয়েট ৫,৫০০ কেজি। ডেডিকেটেড এই কমব্যাট ড্রোনে দুটি ইউক্রেনের ইভশেঙ্কো প্রগ্রেসের তৈরি ৭৫০ হর্স পাওয়ারের এআই-৪৫০টি টার্বোপ্রোপ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। যা ড্রোনটিকে ভূমি থেকে সর্বোচ্চ ৩০-৪০ হাজার ফিট উচ্চতায় সর্বোচ্চ ১৩০ থেকে ১৯৫ নটিক্যাল মাইল বা ৩৬১.১৪ কিলোমিটার বেগে উড়ার ব্যাপক সক্ষমতা প্রদান করে। এটি একবার জ্বালানী নিয়ে আকাশে একটানা ২৪-৩০ ঘন্টা পর্যন্ত কমব্যাট মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম। আর বর্তমানে ড্রোন প্রযুক্তির বিচারে আকিঞ্চির ৩৬১.১৪ কিলোমিটার গতিকে অনেকটাই বেশি গতি সম্পন্ন এরিয়াল (ইউসিএভি) সিস্টেম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এভিয়নিক্স সিস্টেম হিসেবে বায়রাক্তার আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) এ নিজস্ব দেশীয় প্রযুক্তির (এইএসএ) রাডার, ইলেকট্রনিক্স সাপোর্ট পড এবং সাইট এণ্ড স্যাটালাইট কমিউনিকেশন সিস্টেম, এসানসাল কমন এপারচার টার্গেটিং সিস্টেম এবং ইলেকট্রনিক্স ওয়ারফার সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে।

এর ৬টি হার্ড পয়েন্টে মোট ১,৩৫০ কেজি পর্যন্ত মিসাইল, গাইডেড এণ্ড আনগাইডেড বম্বস বহন করতে সক্ষম। তাছাড়া ক্রুজ মিসাইল বহন করার পাশাপাশি এয়ার টু এয়ার মিসাইল হীটে আকাশেই শত্রু পক্ষের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংস করার সক্ষমতা তুরস্কের এই কমব্যাট ড্রোনটিকে বিশ্বের বুকে একটি শ্রেষ্ঠ কমব্যাট ড্রোনের স্থানে নিয়ে গেছে। এই কমব্যাট ড্রোনটিতে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি এমএএম-এল, এমএএম-সি, জাভেলিন, এল-ইউএমটিএএস, বোজক, এমকে-৮১, এমকে-৮২, এমকে-৮৩, উইংড গাইডেন্স কিট (ইউপিএস) এমকে-৮২ ডিভাইসের পাশাপাশি গুলুকান, বোজডোয়ান এবং এসওএম-এ স্ট্যাণ্ড অফ ক্রুজ মিসাইল (এয়ার লাউঞ্চ ক্রুজ মিসাইল) দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। তাছাড়া রকেটসানের তৈরি (এল-ইউএমটিএএস) এন্টি ট্যাংক মিসাইল এটিতে ইনস্টল করা হয়েছে।

এই কমব্যাট ড্রোননটিকে পূর্বের টিবি-২ ড্রোনের মতোই এডভান্স অটোনোমাস কন্ট্রোলিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি অটোনোমাস রোবটের মতো নিজে নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেকঅফ এবং ল্যাণ্ডিং করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া ড্রোনটির রানওয়ে বা বেইস নির্দিষ্ট করা থাকে এবং আগে থেকেই এটির ভৌগলিক অবস্থান ড্রোনটির সফটওয়ার প্রোগ্রামে ইনস্টল থাকে৷ তাই আপদকালীন মুহুর্তে ল্যাণ্ড বেসড কমাণ্ড সেন্টারের সাথে ড্রোনটির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, সেক্ষেত্রে ড্রোনটি তার স্যাটালাইট নেটওয়ার্কিং সিস্টেম ও নিজস্ব জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার নির্ধারিত রানওয়ে বা ঘাঁটিতে ফিরে আসার উপযোগী করে নতুন কিছু গোপন প্রযুক্তি ইনস্টল করেছে তুর্কী বায়কার মাকিনা কোম্পানি।

আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোনের উৎপাদন খরচ বা আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য কত হতে পারে কৌশলগত কারণে তার কোন তথ্য প্রতিষ্ঠানটি প্রকাশ না করলেও মনে করা হয় এর আনুমানিক উৎপাদন ব্যয় খুব সম্ভবত ১৫ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তবে ৬টি আকিঞ্চি কমব্যাট ড্রোন, ২টি ল্যাণ্ড স্টেশন এবং প্রশিক্ষণসহ এর রপ্তানির আনুমানিক মূল্য হতে পারে ১২০-১৫০ মিলিয়ন ডলার। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যেই তুরস্ক সারা বিশ্বে নুন্যতম ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কমব্যাট এণ্ড নন-কমব্যাট ড্রোন সিস্টেমসহ ডিফেন্স ইকুইপমেন্ট খাতে মোট প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী দেশটি। তাছাড়া দেশটি ২০২১ সালে মোট ৪৩.৩ বিলিয়ন তুর্কী লিরা বা ৩.২২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম সারা বিশ্বে রপ্তানি করেছে।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman) সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top