বাংলায় মুসলিম শাসন- Islam in Bangladesh

পর্ব নম্বর-১: বাংলায় মুসলিম শাসন- Islam in Bangladesh

ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের ফলে এ দেশে (বাংলায়) সর্বপ্রথম মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। এ সময় থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল, আফগানিস্তান, ইরান, আরব ও তুরস্ক থেকে মুসলমান বাংলায় আগমন করতে থাকেন। অধিকাংশ এসেছিলো সৈনিক হিসাবে, বাকিরা ব্যবসা-বাণিজ্য, ইসলাম প্রচার এর উদ্দেশ্যে। এভাবে বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা হয়ে পড়ছিল ক্রমবর্ধমান।

মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের বাংলা বিজয় ছিল এক অতিবিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি ছিলেন তুর্কিস্তানের খিলজি বংশসম্ভূত। তাই তাঁর বংশ পরিচয়ের জন্যে তাঁর নামের শেষে খাজী বা খিলজী শব্দ যুক্ত করা হয়। তাঁর পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি ছিল সীস্তানের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত গারামসীর অথবা দাতে মার্গো। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজী জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি ত্যাগ করে গজনী এবং পরে ভারতের বাদাউনে আগমন করেন। তাঁর দেহ ছিল খর্ব ও হস্তদ্বয় অস্বাভাবিক রকমের দীর্ঘ। সম্ভবতঃ এ কারণেই গজনী ও দিল্লীর সামরিক বাহিনীতে তাঁর চাকুরীর আবেদন গৃহীত হয়নি। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে অসীম সাহসিকতা ও দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনার যোগ্যতা ছিল তা বুঝতে পেরে বাদাউনের তাঁকে সেনাবাহিনীতে সিপাহসালার নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই তাঁর ভাগ্যোন্নয়ন শুরু হয়। তিরৌরী বা তরাইনের যুদ্ধের পর বখতিয়ারের চাচা, মুহাম্মদ-ই-মাহমুদ নাগাওরীর শাসনকর্তা আলী নাগাওরীর নিকট থেকে কষমন্ডী বা কষ্টমন্ডীর অধিকার লাভ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বখতিয়ার তার অধিকার লাভ করেন। কিছুকাল পর তিনি অযোধ্যার মালিক মুয়াজ্জম হিসামউদ্দীনের নিকট গমন করেন। এ সময়ে তিনি অশ্ব ও অস্ত্রশস্ত্রাদি সংগ্রহ করেছিলেন বলে মালিক হিসামউদ্দীন তাঁকে দু’টি গ্রাম উপঢৌকন স্বরূপ দান করেন। গ্রাম দুটি কারো মতে ভগবৎ ও ডোইলি, কারো মতে সহলন্ড ও সহিলী অথবা কম্পিলা ও পতিয়ালি ছিল। গোলাম হোসেন সলিমীর ‘রিয়াযুস্ সালাতীনে এ গ্রাম দুটির নাম বলা হয়েছে কম্বালা ও বেতালি।

বিহার জয়:

১২০১ সালে বখতিয়ার মাত্র দু হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো আক্রমণ করতে থাকেন। সেই সময়ে তার বীরত্বের কথা চারিদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং অনেক মুসলিম সৈনিক তার বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে, এতে করে তার সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে তিনি একদিন এক প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের মতো স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন। প্রতিপক্ষ কোনো বাধাই দেয় নি। দুর্গজয়ের পর তিনি দেখলেন যে দুর্গের অধিবাসীরা প্রত্যেকেই মুণ্ডিতমস্তক এবং দুর্গটি বইপত্র দিয়ে ভরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি জানতে পারলেন যে তিনি একটি বৌদ্ধ বিহার জয় করেছেন। এটি ছিল ওদন্ত বিহার বা ওদন্তপুরী বিহার। সেই সময় থেকেই মুসলমানেরা জায়গাটিকে বিহার বা বিহার শরিফ নামে ডাকে।

বিহার জয়ের পর বখতিয়ার খলজি অনেক ধনরত্ন সহ কুতুব-উদ্দিন আইবকের সাথে দেখা করতে যান এবং কুতুবউদ্দিন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে ফিরে আসেন। এর পরই তিনি বাংলা জয়ের জন্য সাহস এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন।

বাংলা জয়:

অতঃপর তাঁর অভিযান বাংলার দিকে পরিচালিত হয় এবং ১২০৩ খৃস্টাব্দে বাংলার রাঢ় ও বরিন্দ অঞ্চল অধিকার করেন। বাংলা আক্রমণকালে এর শাসক ছিলেন রায় লক্ষ্মণ সেন। রাজধানী ছিল নদিয়া। রাজধানীসহ এ অঞ্চলটিকে লক্ষ্মণাবতী বলা হতো। ‘তাবাকাতে নাসিরী’তে এ সম্পর্কে এক মজার কাহিনী বিবৃত হয়েছে।

রাজ দরবারের গণক ব্রাহ্মণের দল এক ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন যে, এ দেশ অচিরেই তুর্কী মুসলমানদের হস্তগত হবে। দেশ আক্রান্ত হলে রাজাকে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় দেশবাসীকে প্রচুর রক্তপাত ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হবে।

রাজা ব্রাহ্মণ-পন্ডিতগণকে জিজ্ঞাসা করেন যে, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে এহেন মুসলিম অভিযানকারীর কোন চিহ্ন বর্ণনা করা হয়েছে কিনা, যা দেখে তাকে যথাসময়ে চিনতে পারা যায়। তাঁরা বলেন যে, সে তুর্কী সেনা সোজা দন্ডায়মান হলে তাঁর হস্তদ্বয় হাঁটু পর্যন্ত লম্বিত হবে। রাজা রায় লক্ষ্মণ সেন এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাবার জন্যে একদল বিশ্বস্ত লোক নিযুক্ত করেন। তাঁরা অনুসন্ধানের পর রাজাকে বলেন যে, মুহাম্মদ বখতিয়ারের মধ্যে উপরোক্ত চিহ্ন বিদ্যমান। এদিকে মুহাম্মদ বখতিয়ারের দুঃসাহসিক অভিযান ও তাঁর জয়জয়কার কারো অজ্ঞাত ছিল না। ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ, সম্মানী ও জ্ঞানী-গুণী, ভূস্বামী প্রধান প্রধান ব্যক্তি দেশ-পরিত্যাগ করে জগন্নাথ, কামরূপ এবং অন্যান্য নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাজা তখনো তাঁর রাজধানী পরিত্যাগ করা সমীচীন মনে করেননি। হঠাৎ এক সময় মুহাম্মদ বখতিয়ার নদিয়া আক্রমণ করে রাজধানীতে প্রবেশ করলে, রাজা রাজ প্রাসাদের পশ্চাদ্বার দিয়ে পলায়ন করে বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এভাবে সমগ্র লক্ষ্মণাবতী বখতিয়ারের করতলগত হয়— বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, মাত্র সতেরো জন অশ্বারোহীসহ মুহাম্মদ বখতিয়ার নদিয়া আক্রমণ ও জয় করেন।

অতঃপর তাঁর অভিযান বিস্তার লাভ করে এবং নবদ্বীপ ও গৌড় তাঁর করতলগত হয়। ‘তারিখে ফেরেশতা’য় বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মদ বখতিয়ার বাংলাদেশে রংপুর নামে এক নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে, বাংলার শুধু পূর্বাঞ্চল ব্যতীত সমগ্র রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিম ও উত্তর বংগ তাঁর শাসনাধীন হয়েছিল। রায় লক্ষ্মণ সেন বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করলেও তাঁর পশ্চাদানুসরণ বতিয়ার করেননি। যার ফলে বাংলার পূর্বাঞ্চল ছিল তাঁর শাসনের বাইরে। এক শতাব্দীকাল পর ১৩৩০ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ তুঘলক শাহ পূর্বাঞ্চল জয় করেন এবং সাতগাঁও ও সোনারগাঁও-এ যথাক্রমে রাজধানী স্থাপন করেন।

যাইহোক, মুহাম্মদ বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের ফলে বহিরাগত মুসলমান দলে দলে এ দেশে বসতিস্থাপন করেন। ব্যবসা বাণিজ্য, সেনাবাহিনীতে চাকুরী ও অন্যান্য নানাবিধ উপায়ে জীবিকার্জনের নিমিত্ত অসংখ্য মুসলমান এ দেশে আগমন করেন এবং এ আগমনের গতিধারা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত।

মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের পর থেকে ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে পলাশী প্রান্তরে মুসলিম রাজ্যের পতন পর্যন্ত পাঁচ শত চুয়ান্ন বৎসরে একশত একজন বা ততোধিক শাসক বাংলায় শাসন পরিচালনা করেন।

তথ্যসূত্রঃ

(১)  “Ikhtiyār al-Dīn Muḥammad Bakhtiyār Khiljī | Muslim general”. Encyclopedia Britannica. Retrieved 9 September 2018.

(২) Sarkar, Jadunath, ed. (1973) [First published 1948]. The History of Bengal. II. Patna: Academica Asiatica.

(৩) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান।

বাংলায় মুসলিম শাসন

পর্ব নম্বর-২

মুসলমানগণ বিজয়ীর বেশে এ দেশে আগমন করার পর এ দেশকে তাঁরা মনেপ্রাণে ভালোবাসেন, এ দেশকে স্থায়ী আবাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করেন এবং এ দেশের অমুসলিম অধিবাসীর সাথে মিলে মিশে বাস করতে চেয়েছেন। শাসক হিসাবে শাসিতের উপরে কোন অন্যায়-অবিচার তাঁরা করেননি। জনসাধারণও তাঁদের শাসন মেনে নিয়েছিল। মুহাম্মদ বখতিয়ার বাংলা বিজয়ের পর আভ্যন্তরীণ আইনশৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি মুসলমানদের জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করলেও অমুসলিমদের প্রতি উদার নীতি অবলম্বন করেন। তিনি ইচ্ছা করলে পলাতক লক্ষ্মণসেনের পশ্চাদানুসরণ করে তাকে পরাজিত করতে পারতেন। কিন্তু সে কথা তিনি মনে আদৌ স্থান দেননি। যদুনাথ সরকার তাঁর ‘বাংলার ইতিহাসে’ বলেন :

…কিন্তু তিনি রক্তপিপাসু ছিলেন না। নরহত্যা ও প্রজাপীড়ন তিনি পছন্দ করতেন না। দেশে এক ধরনের জায়গীর প্রথা বা সামন্ততান্ত্রিক সরকার কায়েমের দ্বারা আভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও সামরিক প্রধানদের সন্তুষ্টি সাধন করতেন।”…

বাংলায় মুসলিম শাসন

(History of Bengal Vol. II, Muslim period p. 9)

মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী তিব্বত অভিযানের সময় বিফল হন এবং দেবকোট (বর্তমানে কি দক্ষিণ দিনাজপুরে পরে) ফিরে আসেন। তিনি দেবকোটে রোগাক্রান্ত হন এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।

মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই লখনৌতির (বর্তমান মালদা জেলার অংশ) মুসলমান রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বখতিয়ার খিলজীর মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁর অন্যতম প্রধান অমাত্য মুহাম্মদ শীরান খিলজী লখনৌতি থেকে তাড়াতাড়ি দেবকোটে ফিরে আসেন। অতঃপর দেবকোটে উপস্থিত খিলজী আমীর এবং সৈনিকবৃন্দ তাঁকে নেতা নির্বাচিত করেন এবং তিনি লখনৌতির শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি সম্ভবত এক বৎসরকাল (১২০৭-১২০৮ খ্রিঃ) শাসন করেন।

এইভাবে সেন বংশের পতনের পর সমগ্র বাংলা দিল্লি সুলতানির অধীনে আসে। বলা বাহুল্য, সমগ্র সুলতানি যুগে বাংলার মুসলিম আধিপত্য কখনই সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়নি। ইলতুৎমিস, বলবন, খিলজী ও তুঘলক শাসনাধীনে বাংলায় বারংবার বিদ্রোহ দেখা দেয়। মহম্মদ বিন-তুঘলকের রাজত্বকালে পূর্ববঙ্গের শাসনকর্তা ফকরউদ্দিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফিরোজ তুঘলক দু’বার চেষ্টা করেও বিদ্রোহ দমন করতে পারেননি এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাকে স্বাধীন রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। এই রাজ্যের প্রথম বিখ্যাত নরপতি শামস্উদ্দিন ইলিয়াস শাহ।

পরবর্তী পর্বে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ…

[মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী থেকে নিয়ে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এর আগ পর্যন্ত বাংলার সমস্ত শাসকদের লিস্ট নিচের চিত্র গুলিতে দেয়া হলো।]

তথ্যসূত্রঃ

(১) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান।

(২) বাংলার ইতিহাস, আব্দুল করিম।

(৩) স্বদেশ পরিচয়, জীবন মুখোপাধ্যায়।

পর্ব নম্বর-৩

ইলিয়াস শাহী রাজবংশ____________

ইলিয়াস শাহী বংশের রাজাদের লিস্টঃ

বাংলায় মুসলিম শাসন

(প্রথম পর্ব)

বাংলায় মুসলিম শাসন

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) (১৩৪২ থেকে পশ্চিম বাংলার লখনৌতি রাজ্যের সুলতান এবং ১৩৫২ থেকে পুরো বাংলায়)

প্রথম সিকান্দর শাহ (১৩৫৮-১৩৯০)

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১)

সাইফুদ্দীন হামজা শাহ (১৪১১-১৪১৩)

মুহাম্মদ শাহ (১৪১৩)

(দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯)

রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪)

শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১)

দ্বিতীয় সিকান্দর শাহ (১৪৮১)

জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭)

ইলিয়াস শাহী রাজবংশ ছিল বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজবংশ। এই রাজ্যের প্রথম বিখ্যাত রাজা ছিলেন শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তিনি দিল্লির অধীন থেকে বাংলাকে আজাদ করে বাংলায় আজাদ সুলতানী কায়েম করেন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ যদিও তার রাজধানী পান্ডুয়ায় স্থাপন করেন, পরবর্তীতে ১৪৫৩ সালে নাসিরউদ্দীন মাহমুদ সেই রাজধানীকে লখনৌতিতে (বর্তমান মালদা ও বাংলাদেশের কিছু অংশ) স্থাপন করেন।

ডঃ যদুনাথ সরকার বলেন যে, “লক্ষ্মণাবতির সিংহাসনে ইলিয়াস শাহের আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হয়”। ডঃ নুরুল হাসান

বলেন “ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় যুগের সূচনা করেন।” তিনি বাংলার তিনটি অংশকে একত্র করে একটি শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেন। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নেপাল আক্রমণ করেন এবং রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রচুর ধনরত্নসহ বাংলায় ফিরে আসেন। তিনি উড়িষ্যা ও ত্রিহুত (উত্তর বিহার) রাজ্যকে করদ রাজ্যে পরিণত করে বারাণসী পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য বিস্তৃত করেন। তিনি কামরূপ আক্রমণ করেন, কিন্তু এর ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা একমত নন। ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলাকে জয় করার উদ্দেশ্যে দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুঘলক ৯০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। দিল্লির সেনাদলকে কোন বাধা না দিয়ে ইলিয়াস শাহ সপরিবারে দিনাজপুরের একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নদীবেষ্টিত এই দুর্গটি কার্যত দুর্ভেদ্য ছিল। কয়েকমাস অবরোধের পরেও ফিরোজ তুঘলক বাংলার নবাবের কোন ক্ষতি করতে পারেননি বরং বাংলার প্রবল বর্ষণ ও মশার কামড়ে সুলতানের সেনাবাহিনী ও ঘোড়াগুলি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং তিনি দিল্লি ফিরে যেতে বাধ্য হন। ইলিয়াস শাহের রাজত্বকালে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের উন্নতির জন্যও তাঁর শাসনকাল স্মরণীয়।

তাঁর পুত্র সিকন্দর শাহ (১৩৫৭-৮৯ খ্রিঃ) পিতার মতই বিচক্ষণ, বীর যোদ্ধা ও সুশাসক ছিলেন। ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীশ্বর ফিরোজ তুঘলক পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিকন্দর শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বেশ কয়েকমাস অবরোধের পরেও ফিরোজ তুঘলক দুর্গ অধিকারে ব্যর্থ হন এবং দু’পক্ষের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি দ্বারা দিল্লি কার্যত বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেয় এবং এর পরে দুইশ’ বছর ধরে আফগানদের অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ আর কখনও দিল্লি কর্তৃক আক্রান্ত হয়নি। তিনি শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর আমলে বাংলায় বহু মসজিদ ও অন্যান্য ইমারত তৈরি হয়। পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ ও কোতোয়ালি দরওয়াজা তাঁর আমলে তৈরি হয়। তাঁর রাজত্বকাল শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ হিসেবে চিহ্নিত

তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি:) দক্ষ ও দয়ালু শাসক ছিলেন। সম্ভবত তিনি কামরূপ ও কুচবিহার রাজ্যের কিছু অংশ ক্রয় করেন। তিনি চিনদেশে মিঙ বংশীয় সম্রাট ইয়ং-লো’-র দরবারে দূত পাঠান। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে জনৈক চৈনিক দ্রুত তাঁর রাজ্যে আসেন এবং সেই দূতের সঙ্গে মা-হুয়ান নামে জনৈক পণ্ডিতও আসেন। মা হুয়ানের রচনায় বাংলার ঐশ্বর্য ও বাঙালির বদান্যতার সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফেজ-এর সঙ্গে তিনি পত্রালাপ করতেন।

গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর একে একে তিনজন দুর্বল উত্তরাধিকারী সিংহাসনে বসেন। এ সময় রাজা গণেশ (১৪১৫-১৮ খ্রিঃ) নামে ভাতুড়িয়া ও দিনাজপুরের জনৈক ব্রাহ্মণ জমিদার প্রভূত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে সিংহাসন দখল করেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তিনি দু’জন নামসর্বস্ব সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য শাসন করতেন। তাঁর উত্তরাধিকারী ছিলেন তাঁর পুত্র যদু। তিনি ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন এবং জালালউদ্দিন (১৪১৮-৩১ খ্রিঃ) নামে পরিচিত হন।পূর্ববঙ্গ ও চট্টগ্রাম-সহ সমগ্র বাংলাদেশ তাঁর অধীনস্থ ছিল। তাঁর সুদক্ষ শাসনে বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন আহম্মদ (১৪৩১-৪২ খ্রিঃ) প্রবল অত্যাচারী ছিলেন। তাঁর কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে আমির-ওমরাহগণ তাঁকে হত্যা করে নাসিরউদ্দিন মামুদ নামে ইলিয়াস শাহের এক বংশধরকে সিংহাসনে বসান।

নাসিরুদ্দিন মাহমুদ (১৪৪২-৫৯ খ্রিঃ) -এর রাজত্বকাল প্রজাদের কাছে সুখ ও সমৃদ্ধির কাল হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর আমলে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলার সীমানা সংকুচিত হয়, কারণ উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্রদেব ও আরাকান রাজ বাংলার দুই অংশের কিছু স্থান দখল করে নেন। পরবর্তী সুলতান রুকনউদ্দিন বারবক শাহ (১৪৫ ৭৪ খ্রিঃ) কামরূপ ও উড়িষ্যার বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করে কয়েকটি অঞ্চল দখল করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বারবকের পর শামউদ্দিন ইউসুফ (১৪৭৪-৮১ খ্রিঃ) ও জালালউদ্দিন ফতে শাহ (১৪৮৭ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হাবসি ক্রীতদাস জালালউদ্দিনকে হত্যা করলে ইলিয়াস শাহি বংশের অবসান ঘটে।

বাংলায় মুসলিম শাসন

তথ্যসূত্রঃ

(১) স্বদেশ পরিচয়, জীবন মুখোপাধ্যায়।

(২) History of bengal, Vol-2, Jadunath Sarkar

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top