পবিত্র সীরাতের সান্নিধ্য

পবিত্র সীরাতের সান্নিধ্য : কেন ও কীভাবে?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত পাঠের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান-প্রজ্ঞা, দ্বীন-ঈমান, আদব-আখলাক, আদর্শ জীবন গঠন ও আল্লাহর দিকে দাওয়াত ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে অতুলনীয় পাথেয় অর্জন করতে পারি। এখানে আলাদা আলাদা শিরোনামে কিছু নমুনা আলোচনা করছি।

এক. ঈমান ও বিশ্বাসের দিক থেকে

পবিত্র সীরাত পাঠের অনন্য প্রাপ্তি হচ্ছে ঈমান-বৃদ্ধি। প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস সাক্ষী যে, পবিত্র সীরাত যুগে যুগে অসংখ্য মানুষকে ঈমানের পথ দেখিয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হওয়া কুরআন, সেই কুরআনের আলোয় উদ্ভাসিত তাঁর বাস্তব জীবন, তাঁর অনন্য চরিত্র-মাধুর্য, তাঁর মহত্ব, মহানুভবতা যুগে যুগে অসংখ্য মানুষকে ঈমান ও বিশ্বাসের স্নিগ্ধ ছায়াতলে নিয়ে এসেছে। তাঁর পবিত্র জীবন তাঁর নবুওত ও রিসালাতের এক দেদীপ্যমান প্রমাণ, যার প্রভাব কোনো ন্যায়নিষ্ঠ হৃদয় ও মস্তিষ্ক এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই তাঁর পবিত্র জীবন ও কর্ম ঈমানের আলোক বঞ্চিত প্রত্যেক ন্যায়নিষ্ঠ মানবের পক্ষে ঈমান লাভের মাধ্যম আর ঈমানের আলোকপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান মানবের ঈমান-বৃদ্ধির উপায়। তবে এর জন্য খোলা মন নিয়ে পবিত্র সীরাতের সান্নিধ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সৌভাগ্যবান মুমিনের জন্য পবিত্র সীরাতের অধ্যয়ন ও আনুগত্য যে অনন্য প্রাপ্তি নিয়ে আসে তা হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও ভালবাসা। মুমিন যতই তাঁকে জানবে ততই তাঁর মহানুভবতার সাথে পরিচিত হবে, মানবজাতির প্রতি তাঁর মহাঅনুগ্রহের দিগন্ত ততই তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকবে। মানুষ তো মানুষকে তার মনুষ্যত্ব, মহানুভবতা ও অনুগ্রহের কারণে ভালবেসে থাকে।

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. সীরাত পাঠের উপকারিতা বর্ণনা করে লেখেন-

اس سے اپنے آقا پیغمبر صلی اللہ علیہ وسلم کی ضروری معرفت ہوگی، اور اس معرفت سے بہ لزوم عادی  آپ کی محبت  اور اس محبت سے حسب وعدۂ صادقہ جنت میں آپ کی معیت نصیب ہوگی،  اور اس کے نعمت عظمی ہونے  میں کس کو کلام ہو سکتا ہے۔ (مقدمہ سیرت مصطفی ، ادریس  کاندھلوی)

সীরাত অধ্যয়নের দ্বারা নিজের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিচিতি লাভ হবে। আর এ পরিচয় লাভের মাধ্যমে অনিবার্যভাবে সৃষ্টি হবে, নবীজীর প্রতি ভালবাসা। যে ভালোবাসার দরুন সত্য প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী লাভ হবে জান্নাতে তাঁর সঙ্গ ও সান্নিধ্য। আর এটা যে এক মহা নিআমত তাতে কি কারো দ্বিমত আছে? (ভূমিকা, বাণী অংশ, সীরাতে মুস্তফা হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী)

এই মহব্বত ও ভালবাসাই হচ্ছে ঐ মহাসম্পদ, যা দ্বীনের পথে চলা সহজ করে দেয়। এ পথের ছোট-বড় ত্যাগ ও কুরবানীকেও বানিয়ে দেয় এক অপার্থিব আনন্দের উপকরণ, যার প্রাণবন্ত নমুনা দেখা যায় তাঁর মহান সাহাবীদের জীবন ও কর্মে। রিযওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন।

এ প্রসঙ্গে মুফাককিরে ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর একটি বক্তব্য তুলে দিচ্ছি, যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিষয়বস্তুর গভীরতা উপলব্ধির পক্ষে সহায়ক হবে বলে মনে করি। তিনি লেখেন-

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ ও খাঁটি আনুগত্য, তাঁর আদব-আখলাকের অনুসরণ, শরীয়তের নীতি ও বিধানকে প্রবৃত্তির চাহিদা ও সামাজিক রসম-রেওয়াজের উপর প্রাধান্য দেওয়া এবং দাওয়াতের পথে জান-মালের কুরবানী পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়, যদি এই গভীর, আন্তরিক ও মন-মস্তিষ্ককে আচ্ছন্নকারী মহব্বত না থাকে। একারণে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ اِنْ كَانَ اٰبَآؤُكُمْ وَ اَبْنَآؤُكُمْ وَ اِخْوَانُكُمْ وَ اَزْوَاجُكُمْ وَ عَشِیْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُ ِ۟اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَ تِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَ مَسٰكِنُ تَرْضَوْنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیْكُمْ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ جِهَادٍ فِیْ سَبِیْلِهٖ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللّٰهُ بِاَمْرِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ.

বল, তোমাদের কাছে যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের খান্দান, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের সেই ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। -সূরা তাওবা (৯) : ২৪

এ মহব্বতের কারণেই সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের বিষয়ে লালায়িত ও আগুয়ান ছিলেন এবং এক্ষেত্রে অনুপম প্রাণবন্ততা, ধৈর্যশীলতা, সংযম ও কষ্টসহিষ্ণুতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এসব বিষয়ে তাঁরাই সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ।

হযরত সিদ্দীকে আকবর রা.-এর দৃষ্টান্ত দেখুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাণ তাঁর কাছে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল। নিজের জীবন ও সুস্থতার চেয়েও তিনি অগ্রগণ্য মনে করতেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ও সুস্থতাকে। ফলে নিষ্ঠুর উতবা ইবনে রবীআ যখন তাঁর মুখম-ল আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছিল, তাঁর বুকের উপর চড়ে বসে তার উপর নিদারুণ নির্যাতন করেছিল, খবর পেয়ে তার গোত্র বনু তাইম তাকে এমন অবস্থায় উদ্ধার করল যে, তার মারা যাওয়ার ব্যাপারে কারো সংশয় ছিল না। এ অবস্থায়ও দিন শেষে হুঁশ ফিরে পাওয়ার পর সবার আগে যে কথা তার মুখে উচ্চারিত হয়েছিল তা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরাপদ আছেন তো। কওমের লোকেরা তাকে আশ্বস্ত করার পরও তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না, বললেন-

فَإِنّ لِلهِ عَلَيّ أَنْ لَا أَذُوقَ طَعَامًا وَلَا أَشْرَبَ شَرَابًا أَوْ أَتَى رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.

আল্লাহর কসম! আমি ঐ পর্যন্ত দানাপানি স্পর্শ করব না, যে পর্যন্ত না তাঁর সান্নিধ্য ও দর্শন পাই! -আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৩০

এইরকম প্রাণোৎসর্গকারী আশিকদের আরেক দৃষ্টান্ত ঐ আনসারী সাহাবিয়া, যাকে উহুদ যুদ্ধের পর একে একে তাঁর বাবা, ভাই ও স্বামীর শাহাদাতের সংবাদ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এইসব সংবাদকে উপেক্ষা করে তিনি শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিরাপদ থাকার সংবাদই জানতে চাচ্ছিলেন। লোকেরা যখন তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিরাপদ থাকার সংবাদ জানাল এবং তিনি স্বচক্ষে তাঁর দর্শন লাভ করলেন তখন বলে উঠলেন-

كُلّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ!

(আল্লাহর রাসূল! আপনি যখন নিরাপদ আছেন তো সব মুসীবত আমার কাছে তুচ্ছ।) -দালাইলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকী ৩/৩০২; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৯৯

এমনই উৎসর্গপ্রাণ সাহাবীদের একজন আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ বিন উবাই, যিনি তার বাবা (বিখ্যাত মুনাফেক) আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে বলতে শুনেছিলেন যে, ‘আমরা মদীনায় ফেরার পর সম্মানিত লোকেরা তুচ্ছ লোকদেরকে বের করে দেব।’ তিনি তখন বাবার বিরুদ্ধে মদীনার দরজায় তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরাই এমন কথা বলেছিলে? তো এখনই প্রমাণ হয়ে যাবে, সম্ভ্রান্ত ও  সম্মানিত কি তোমরা, না রাসূলুল্লাহ! তোমরা ঐ পর্যন্ত মদীনার ছায়ায় ঢুকতে পারবে না, যে পর্যন্ত না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে ঢোকার অনুমতি দেন। এরপর সত্যি সত্যি তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতির আগ পর্যন্ত তার বাবাকে মদীনায় ঢুকতে দেননি।

এই জযবা ও নবীপ্রেমের কারণেই তাঁরা তাদের প্রাণকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে পেরেছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য স্বজন-স্বদেশ ত্যাগ করা ও আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত বরণ করা তাদের জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল। বরং হিজরত ও শাহাদাতের বিপরীতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাই তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। এই অতুলনীয় সমর্পণ ও ভালবাসার কারণেই বদরের যুদ্ধের সময় তারা বলতে পেরেছিলেন-

إن أمرنا تبع لأمرك، فو الله لئن سرت حتى تبلغ البرك من غمدان لنسيرنّ معك، والله لو استعرضت بنا هذا البحر لخضناه معك.

আমাদের সব বিষয়  আপনার হুকুমের অধীন। আল্লাহর কসম! আপনি যদি সুদূর বারক গামদান পর্যন্তও ভ্রমণ করেন আমরা আপনার সাথেই থাকব। আল্লাহর কসম! আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে এই সমুদ্রেও আমরা আপনার সাথে ঝাঁপ দেব।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের এই অতুলনীয় ভালবাসার বৃত্তান্ত আলোচনা করার পর মুফাককিরে ইসলাম হযরত আলী নদভী রাহ. লেখেন-

আজ মুসলিমজাহানে শরীয়তের বিধি-বিধান পালনে যে ত্রুটি, নেক আমলের ব্যাপারে যে উদাসীনতা, ত্যাগ ও কষ্টের যে কোনো বিষয়ে যে পলায়নপরতা এবং সুন্নতের পাবন্দীর ক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের যে অবসাদ, আলস্য- এই সবকিছুর মূলেই আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা ও মহাত্মের অনুপলব্ধি। যে ব্যাপারে স্বয়ং কুরআন মাজীদে অত্যন্ত তাকীদ রয়েছে। এরইসাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বত-ভালবাসার অভাবও এর এক বড় কারণ।

মনে রাখতে হবে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের ভালবাসাই হচ্ছে ঐ প্রাণসঞ্জিবনী প্রেরণা, যা আশ্চর্য শক্তি ও উদ্যমের উৎস হিসেবে এবং ইতিহাসের বিস্ময়কর কীর্তি ও ঘটনাবলির জন্য অতীতেও প্রসিদ্ধ ছিল,  বর্তমানেও প্রসিদ্ধ। এই প্রেম ও জযবার শূন্যস্থান বিচার-বুদ্ধি, সংকল্প ও ব্যবস্থার প্রাচুর্য দ্বারা কিছুতেই পূরণ করা যাবে না। এটা এমনই এক অপূর্ণতা, যার ক্ষতিপূরণ অন্য কিছু দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয়। -মানসিবে নবুওত আওর উসকে আলী মাকাম হামেলীন, পৃ. ১২৮-১৩১

দুই. তাকওয়া ও দ্বীনদারির দিক থেকে

কাকে বলে তাকওয়া, কাকে বলে দ্বীনদারি তা যদি জানতে হয় তাহলে পবিত্র সীরাতের সান্নিধ্যে আসতে হবে। তিনিই তো আদর্শ গোটা মানবজাতির। তাঁর পবিত্র জীবনই হচ্ছে আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ের বরং আদ্ল ও ইহসানের সর্বোত্তম নমুনা। তাকওয়া ও দ্বীনদারিকে যদি দু’টো শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে হয় তাহলে তা আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়- এই দুই শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা সম্ভব। দ্বীনদারির উচ্চতর স্তরগুলোকেও যদি শামিল করতে হয় তাহলে কুরআন মাজীদের অনন্যসাধারণ দুই শব্দ- ‘আদ্ল’ ও ‘ইহসানের’ শরণাপন্ন হতে হবে । সহজ-সরল ভাষায় আমরা এ দুই শব্দের তরজমা করতে পারি- ‘ন্যায়পরায়ণতা’ ও ‘অনুগ্রহপরায়ণতা’। জীবনজুড়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই দুই স্তরের কোনো একটিতে থাকতে পারাই তো যথার্থ তাকওয়া। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর বান্দাদের ক্ষেত্রে তাকওয়ার উচ্চতম স্তরের বাস্তব ও প্রোজ্জ্বল নমুনার নাম পবিত্র সীরাত। কাজেই যথার্থ মুত্তাকী হতে হলে, পবিত্র ও মহৎ জীবনের অধিকারী হতে হলে অবশ্যই আমাদের পবিত্র সীরাতের কাছেই ফিরে আসতে হবে।

আজ মুসলিম-সমাজেও পবিত্র ও নির্মল জীবনের, সদাচার ও সচ্চরিত্রের, উদারতা ও মহানুভবতার, উন্নত চিন্তা ও ভারসাম্যপূর্ণ কর্মের যে অভাব পরিলক্ষিত হয় তার এক বড় কারণ হচ্ছে পবিত্র সীরাত থেকে দূরে সরে যাওয়া। আল্লাহ মাফ করুন, আজ মুসলিম-সমাজেরই এক বিরাট অংশের, বিশেষত তরুণ ও নতুন প্রজন্মের আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নন, তাদের আদর্শ এমন সব নর-নারী, যাদের কাছে না ছিল ঈমানের সম্পদ, না সদাচার-সচ্চরিত্রের সৌরভ। সেইসব বিচ্যুত বিপথগামী এবং অতি ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত ইহজাগতিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী নারী-পুরুষকে জীবন ও কর্মের আইডল হিসেবে গ্রহণ করে মুসলিম তরুণ-প্রজন্ম বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার গভীর গহ্বরের দিকেই ধাবমান।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, তরুণ প্রজন্মই উম্মাহর ভবিষ্যত। উম্মাহর এই শ্রেণিটিকে যদি অবক্ষয়-অধঃপতন থেকে রক্ষা করতে হয়, যথার্থ ও মহৎ জীবনাদর্শের সন্ধান দিয়ে জীবন  ও জগৎ সম্পর্কে উন্নত চেতনার তৃষ্ণা তাদের মন-মননে জাগ্রত করতে হয় তাহলে তাদেরকে পবিত্র সীরাতের সাথেই পরিচিত করতে হবে। মহান আল্লাহ তাআলা সীরাতকে নিখুঁতভাবে সংরক্ষণই করেছেন কিয়ামত পর্যন্ত সকল শ্রেণির মানুষের সৌভাগ্যের সূতিকাগার হিসেবে।

তিন. দাওয়াত ইলাল্লাহর দিক থেকে

ইসলামে দাওয়াত ঐচ্ছিক বিষয় নয়, অবশ্যপালনীয় বিধান। প্রত্যেক মুসলিমকে স্ব স্ব যোগ্যতা ও সক্ষমতা অনুসারে ইসলামের কল্যাণপূর্ণ আদর্শের দিকে দাওয়াত দিয়ে যেতে হবে। এখানে একথাও মনে রাখতে হবে যে, এই অপরিহার্য দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত নিয়ম-নীতি আছে, যা অনুসরণ করে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথায় তা দ্বীনী কাজ হিসেবে গণ্য হবে না এবং তাতে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের আশঙ্কাই বেশি থাকবে।

ইসলামী দাওয়াতের এই নিয়ম-নীতি ও তার বাস্তব প্রায়োগিক নমুনা কোথায় পাওয়া যাবে? তা পাওয়া যাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতে। কারণ গোটা নবী-জীবনই হচ্ছে এককথায় দাওয়াতী জীবন। আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর পথের দায়ী ও উজ্জ্বল প্রদীপ রূপেই পাঠিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَ دَاعِیًا اِلَی اللهِ بِاِذْنِهٖ وَ سِرَاجًا مُّنِیْرًا.

এবং আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও আলো বিস্তারকারী প্রদীপরূপে। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৬

অতএব পবিত্র সীরাত ও সুন্নাহ থেকেই জানতে হবে দাওয়াতের ব্যাপ্তি ও বিষয়বস্তু, দাওয়াতের কর্ম ও কর্ম-পদ্ধতি, দায়ীর গুণ, যোগ্যতা, শর্ত ও বৈশিষ্ট্য। তাঁর পবিত্র জীবন-চরিতের স্বচ্ছ দর্পণেই দেখা যাবে- কেমন হয় আল্লাহর পথের দায়ীর আদব-আখলাক, উদারতা-মহানুভবতা, মানুষের প্রতি শুভকামনা ও কল্যাণকামিতা। এখানেই দেখা যাবে, ধৈর্য্য ও বুদ্ধিমত্তার অনন্য দৃষ্টান্ত। দেখা যাবে, দাওয়াতের পথে গভীর নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার এবং ত্যাগ ও কুরবানীর অতুলনীয় নমুনা। সর্বোপরি সীরাতের পাঠশালা থেকেই অর্জিত হবে দাওয়াতের ক্ষেত্রে ‘সুন্নাতুল্লাহ’ বা আল্লাহ তাআলার নিয়ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, যা দায়ীর সামনে তার চলার পথকে আলোকিত করে দেবে।

দায়ীয়ে ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. লেখেন-

‘নবীগণের জীবন ও কর্মকে সংরক্ষণকারী একমাত্র গ্রন্থ আলকুরআনুল কারীম যিনি পাঠ করবেন তিনি খুব পরিষ্কারভাবে এই দৃশ্য দেখতে পাবেন যে, আল্লাহর নবীগণ সবসময় অত্যন্ত অন্ধকার ও বিরূপ পরিবেশে প্রেরিত হয়েছেন। বাহ্যিক উপায়-উপকরণের দিক থেকেও তারা সবল-সমৃদ্ধ ছিলেন না। অর্থ-সম্পদ, রাজ্য-ক্ষমতা, সঙ্গী-সহচর এবং এ ধরনের উপায়-উপকরণ, যা নিয়ে মানুষ গর্ব করে থাকে, সবই ছিল তাদের প্রতিপক্ষের কব্জায়। আম্বিয়ায়ে কেরামের সম্পদ ছিল সব রকমের দ্বিধা ও সংশয়মুক্ত অটল ঈমান, লোভ-লালসা ও কপটতার মিশ্রনহীন খাঁটি ইখলাস, পরম আল্লাহমুখিতা, আল্লাহর উপর অগাধ ভরসা ও নির্ভরতা, তাঁরই চৌকাঠের ভিখারী হওয়া, সৎকর্ম, তাকওয়া, সচ্চরিত্র ও সদাচার এবং এইসকল গুণাবলির পাশাপাশি ঐ বিশুদ্ধ ঈমানী দাওয়াত, যার সাফল্যের নিশ্চয়তা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দান করেছেন।

ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ یَوْمَ یَقُوْمُ الْاَشْهَادُ.

নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে এবং মুমিনদেরকে পার্থিব জীবনেও সাহায্য করি এবং সেই দিনও করব, যেদিন সাক্ষীগণ দাঁড়িয়ে যাবে -সূরা মু’মিন (৪০) : ৫১

كَتَبَ اللهُ لَاَغْلِبَنَّ اَنَا وَ رُسُلِیْ  اِنَّ اللهَ قَوِیٌّ عَزِیْزٌ.

আল্লাহ লিখে দিয়েছেন, আমি ও আমার রাসূলগণ অবশ্যই জয়যুক্ত হব। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি শক্তিমান, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। -সূরা মুজাদালা (৫৮) : ২১

وَ لَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِیْنَ. اِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُوْرُوْنَ.  وَ اِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغٰلِبُوْنَ.

আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে পূর্বেই আমার একথা স্থিরীকৃত রয়েছে যে, নিশ্চিতভাবেই তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। এবং নিশ্চয়ই আমার বাহিনীই হবে জয়যুক্ত। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১৭১-১৭৩

কুরআনের ঈমানদার পাঠক আরো দেখতে পাবেন যে, আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলের যেসব ঘটনা, তাঁদের দাওয়াতের যে বর্ণনা এবং এক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া দ্বন্দ্ব-সংঘাত, লড়াই, চক্রান্ত, কওমের সম্মিলিত শত্রুতা ও জোটবদ্ধতার যে বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন, তাতে সবসময় একদিকে ছিল কোনো কমজোর মর্দে ফকীর, অন্যদিকে কোনো বিত্তবান প্রভাবশালী গোষ্ঠী অথবা কোনো স্বৈরাচারী শাসক। কিন্তু এই ভীতিকর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যে পরিণাম কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে তা হচ্ছে, পরিশেষে নববী দাওয়াতের ঝাণ্ডাবাহী ব্যক্তি তার বাহ্যিক দুর্বলতা ও উপকরণহীনতা সত্ত্বেও বিজয়ী হয়েছেন আর বিত্ত-বৈভবের অধিকারী প্রভাবশালী গোষ্ঠী, দাম্ভিক শাসক তাদের সকল ক্ষমতা ও উপায়-উপকরণের প্রাচুর্য সত্ত্বেও ব্যর্থ ও পরাজিত হয়েছে কিংবা এ দাওয়াতের বাধ্য-অনুগত হয়েছে।

ইতিহাসের এই ধারা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়; বরং এ হচ্ছে শাশ্বত আসমানী নিয়ম ও ফয়সালা। আর বলাবাহুল্য যে, আল্লাহ তাআলার শক্তি ও ফয়সালার সাথে ‘অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া’ বা ‘ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া’র কোনো সম্পর্ক নেই। এসব তো নিতান্তই মূর্খ ও কর্মবিমুখ লোকদের সান্ত্বনা লাভের উপকরণমাত্র।

এই ইতিবৃত্ত কুরআন মাজীদে বারবার শোনানো হয়েছে এবং এর দ্বারা ঐ সর্বশক্তিমান সত্তার প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেয়া হয়েছে, যিনি সকল উপায়-উপকরণের স্রষ্টা ও মালিক। উপায়-উপকরণের কার্যকারিতাও তাঁরই হাতে। তাঁরই আদেশে এগুলো কার্যকর হয়, তাঁরই আদেশে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

সেই সর্বশক্তিমান সত্তা এইসকল উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করার পর নিজে অক্ষম হয়ে যাননি। অন্যকে তা দান করে নিজে রিক্তহস্ত হয়ে পড়েননি। কোনো কিছুকে সৃষ্টি বা অস্তিত্ব দানের জন্য, বিজয় ও সাফল্য তৈরির জন্য তিনি এসব উপায়-উপকরণের মুখাপেক্ষীও নন।

এইসকল বৃত্তান্ত হকের শক্তি ও তা বিদ্যমান থাকার যোগ্যতা আর বাতিলের দুর্বলতা ও ভিত্তিহীনতাকে প্রমাণ করে দেয় এবং পাঠককে ঈমানের দাওয়াত দেয়।’ -মানসিবে নবুওত আওর উসকে আলী মাকাম হামিলীন, পৃ. ১৩৩-১৩৫

কুরআন মাজীদে আম্বিয়ায়ে কেরামের দাওয়াতের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে দায়ীয়ে ইসলাম এখানে যা কিছু বলেছেন তা সবচেয়ে বিস্তারিত ও প্রাঞ্জলভাবে দেখা যাবে খাতামুন্নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে। কুরআন মাজীদে তাঁর দাওয়াতের বৃত্তান্তই সবচেয়ে বিস্তারিতভাবে এসেছে। আর তাই কুরআনের ঈমানদার মনোযোগী পাঠক সর্বোত্তম সূত্র থেকে শ্রেষ্ঠ নবী ও শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতের জ্যোতির্ময় সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হয়ে থাকেন। দাওয়াত ইলাল্লাহর অপরিহার্য দায়িত্ব পালনে যার কোনো বিকল্প নেই।

সারকথা হচ্ছে, ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায় প্রত্যেক মুমিনের  যে অপরিহার্য দায়িত্ব- নিজের ও অন্য সকলের ঈমান-আমল গঠনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, এক্ষেত্রে সীরাত ও সুন্নাহ্ই হচ্ছে ঐ নির্বিকল্প আলোকবর্তিকা, কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিনকে বারবার যার কাছে ফিরে আসতে হবে। দেখার বিষয় হচ্ছে, ঐ ঐশী আলোকধারা থেকে কে কতটুকু নিজেকে আলোকিত করে।

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর ভাষায়-

وَإِذَا كَانَتْ سَعَادَةُ الْعَبْدِ فِي الدّارَيْنِ مُعَلّقَةً بِهَدْيِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَيَجِبُ عَلَى كُلِّ مَنْ نَصَحَ نَفْسَهُ وَأَحَبّ نَجَاتَهَا وَسَعَادَتَهَا أَنْ يَعْرِفَ مِنْ هَدْيِهِ وَسِيرَتِهِ وَشَأْنِهِ مَا يَخْرُجُ بِهِ عَنِ الْجَاهِلِينَ بِهِ، وَيَدْخُلُ بِهِ فِي عِدَادِ أَتْبَاعِهِ وَشِيعَتِهِ وَحِزْبِهِ، وَالنّاسُ فِي هَذَا بَيْنَ مُسْتَقِلٍّ وَمُسْتَكْثِرٍ وَمَحْرُومٍ، وَالْفَضْلُ بِيَدِ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ.

যেহেতু বান্দার উভয় জাহানের সৌভাগ্য ও সফলতা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের মাঝেই নিহিত তাই যে নিজের কল্যাণ, মুক্তি ও সফলতা কামনা করে তার কর্তব্য হচ্ছে, নবীজীর সীরাত ও তাঁর হেদায়েত-নির্দেশনা সম্পর্কে এ পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করা, যাতে সে এ বিষয়ে অজ্ঞদের কাতার থেকে বের হতে পারে এবং এর মাধ্যমে সে নবীজীর দল ও অনুসারীদের কাতারে প্রবেশ করতে পারে।

আর এক্ষেত্রে মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত। কেউ তো এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে, কেউ সামান্যই জানে আবার কেউ একেবারেই অজ্ঞ থেকে যায়। বস্তুত এটি আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। তিনি তো মহা অনুগ্রহশীল। (যাদুল মাআদ ১/৬৯)

পবিত্র সীরাতকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে

সীরাত-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান অর্জন ও তার যথার্থ অনুসরণের জন্য দুটো বিষয় খুব মনোযোগের দাবিদার :

এক. সীরাতের জ্ঞান সঠিক সূত্র থেকে গ্রহণ করা। আর

দুই. সঠিক বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝা ও উপলব্ধি করা।

এ দুই শর্ত পূরণ হলে আশা করা যায়, এ অনুসরণ সুন্নাহর অনুসরণ হবে। অন্যথায় তা হবে সুন্নাহর শিরোনামে অন্য কিছুর অনুসরণ।

কোনো রেওয়ায়েত বা বর্ণনা যখন সামনে আসে তখন প্রথমে দেখতে হয় তা বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত কি না। যে কোনো বইয়ে যে কোনো বর্ণনা পাওয়ামাত্রই তা গ্রহণ করার সুযোগ নেই। বিশেষত যেসকল বর্ণনায় কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী উলামা-সুলাহার যুগ যুগ ধরে চলে আসা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং নীতি ও কর্মের বিপরীত কিছু প্রতীয়মান হয়।

এরপর রেওয়ায়েতের অর্থ-মর্ম, প্রয়োগক্ষেত্র ও প্রয়োগ-পদ্ধতি সঠিকভাবে বুঝতে হবে। সঠিকভাবে বোঝার পর যে অনুসরণ হবে, সেটিই হবে প্রকৃত অনুসরণ। অন্যথায় তা প্রকৃত অনুসরণ হবে না। কোনো বর্ণনার ভুল অর্থ বুঝে কেউ যদি তা পালন করে তাহলে সেটিকে ঐ ব্যক্তির বুঝের অনুসরণ বলা যেতে পারে, সীরাতের অনুসরণ বলা যাবে না। কারণ তিনি যে অর্থ অনুসারে আমল করছেন তা তো ঐ বর্ণনায় বলাই হয়নি। কাজেই এ বিষয়ে সতর্ক-সচেতন হতে হবে।

পবিত্র সীরাতকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার ব্যাপারে সতর্ক হওয়াও খুব প্রয়োজন। বিশেষত পশ্চিমের ইহবাদী চিন্তা মুসলিম-সমাজেরও এক শ্রেণির চিন্তাবিদ-দার্শনিককে অত্যন্ত গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। শিক্ষা-দীক্ষা, নিরক্ষরতা দূরিকরণ, মানবসেবা, সমাজসেবা, কর্মসংস্থান, জীবনমানের উন্নয়ন ইত্যাদি কোনো কিছুই ইসলামে নিন্দিত নয়, কিন্তু বর্তমান ইহবাদী জীবন-দর্শন আখেরাতের মুক্তি ও নাজাত সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফেল হয়ে এই সবকিছুকে নিছক জাগতিক উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। এ যেন কুরআন মাজীদের বর্ণনায়ই এক বাস্তব উদাহরণ-

یَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا  وَ هُمْ عَنِ الْاٰخِرَةِ هُمْ غٰفِلُوْنَ.

তারা পার্থিব জীবনের প্রকাশ্য দিকটাই জানে আর আখেরাত সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ গাফেল। -সূরা রূম (৩০) : ৭

ইতিহাসে পাই, পশ্চিমা ইহবাদী চিন্তা-দর্শনের অধিকারী একশ্রেণির সমাজ-বিপ্লবীর দ্বারা বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে শোষক ও স্বৈরাচারী-বিরোধী বহু আন্দোলন-সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে। যেসব সংগ্রামের মানবতাবাদী শ্লোগান ও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর অবস্থান মানুষকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করলেও বলাই বাহুল্য যে, তাতে মানবতার প্রকৃত মুক্তির যোগ্যতা অনুপস্থিত ছিল। একে তো এসব বিপ্লবী দশর্নে না ছিল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আখিরাতের জবাবদিহিতার চেতনার কোনো স্থান, না ছিল মানুষের পারলৌকিক নাজাত ও মুক্তির কোনো বার্তা। দ্বিতীয়ত মানুষের জাগতিক মুক্তি ও সাম্যেরও যথার্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা তাতে অনুপস্থিত ছিল। ফলে এসব ইহবাদী বিপ্লবের শেষ পরিণাম ছিল মানুষকে এক স্বৈরাচারের কারাগার থেকে আরেক স্বৈরাচারের কারাগারে নিক্ষেপ করা।

সমাজ-বিপ্লবের এই ইহবাদী ধারা কাঠামো ও ফলাফলের বিচারে যতই ব্যর্থ ও খণ্ডিত হোক, একটা সময় পর্যন্ত তা ব্যাপকভাবে চর্চিত ও আলোচিত হয়। যুগ যুগ ধরে তা শিল্প-সাহিত্যের এক বিরাট অঙ্গনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।  ফলে এসব চিন্তা-দর্শনের স্লোগান ও পরিভাষা আধুনিক শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দুঃখজনক বিষয় এই যে, মুসলিম-সমাজের একশ্রেণির লেখক-চিন্তাবিদ এই ইহবাদী ধারার সমাজ-বিপ্লবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের ভাষায় ইসলামের দাওয়াতকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন, যা সীরাত ও সুন্নাহকে তার প্রকৃত রূপে বোঝার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মুফাককিরে ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. লেখেন-

‘বর্তমান যুগের কিছু ইসলামপ্রিয় লেখক-সাহিত্যিক, মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের কিছু দায়ী ও নেতৃত্বও ঐসব চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তারা আম্বিয়ায়ে কেরামের দাওয়াত ও সীরাতের ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করেন প্রচলিত রাজনীতি ও সমাজনীতির ভাষায়, যা বর্তমান যুগের মানুষের জন্য নবুওতের স্বরূপ ও মর্যাদা, আম্বিয়ায়ে কেরামের রুচি-প্রকৃতি, তাঁদের পয়গাম ও দাওয়াতের ধরন ও বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সকল কর্মতৎপরতার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সঠিকভাবে বোঝার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং তাদের সঠিক ইত্তিবা ও অনুসরণের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক হচ্ছে। এই চিন্তাধারা মন-মস্তিষ্ককে ঐ রাস্তার দিকে (ইহবাদ) নিয়ে যাচ্ছে, যা নবুওতের পথ-পদ্ধতির সাথে কিছুতেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ -মানসিবে নবুওত, পৃ. ৫৩

আম্বিয়ায়ে কেরামের দাওয়াতের বিশেষত্ব বর্ণনা করে হযরত মাওলানা লেখেন-

‘আম্বিয়ায়ে কেরামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যার মাধ্যমে তাঁরা অন্য সবার চেয়ে আলাদা, তা এই যে, তারা যে ইলম প্রচার করেন, যে আকীদার দিকে মানুষকে ডাকেন এবং যে পয়গামের তাবলীগের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত- তা না তাদের মেধা ও মননের ফসল, না তাদের চারপাশের সামাজিক অনাচার-অবক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া, না তাদের সূক্ষ্ম সংবেদনশীল অনুভব-অনুভূতির সৃষ্টি, আর না তাদের ব্যাপক ও গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ অভিজ্ঞতার ফলাফল; বরং এর সূত্র হচ্ছে আসমানী ওহী ও নির্দেশনা, যা ধারণ ও বহনের জন্য তারা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্বাচিত ও সৌভাগ্যপ্রাপ্ত। একারণে কিছুতেই তাদেরকে অন্য সকল কবি-দার্শনিক, সমাজ-চিন্তক ও সমাজপতির কাতারে দাঁড় করানো যায় না, কারণ এদের উপস্থাপিত মতবাদ হয়তো তাদের চারপাশের সমাজ ও পরিবেশের ফসল, অথবা তাদের ব্যক্তিগত মেধা-মননের ফলাফল কিংবা পরিবেশ-পারিপাশির্কতার প্রতিধ্বনি আর না হয় চারপাশের অবিচার-অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া।

এই প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সূক্ষ্ম লক্ষণসমূহ- যা কখনো কখনো অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া দৃষ্টিগোচর হয় না- এমন অনেক ইসলামপ্রিয় লেখক-চিন্তকের লেখাজোখায় দৃষ্টিগোচর হয়, যাদের বর্তমান ইহবাদী জীবন-দর্শন, পশ্চিমা রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা, নিজ দেশের মুসলমানদের অব্যবস্থিত জীবনযাত্রা বা গোলামীর যিন্দেগী ইসলামের পাঠ ও অধ্যয়নে, পরিস্থিতির মোকাবেলায় এবং ঐসকল দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থার সমান্তরালে ‘ইসলামী দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থা’র উপস্থাপনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তাদের আলোচনা, উপস্থাপনা ও চিন্তার গতিপ্রকৃতির মধ্যে এই প্রতিক্রিয়ার ছায়া এমন যে কোনো ব্যক্তির খুব সহজেই দৃষ্টিগোচর হতে পারে, যিনি পরিবেশের প্রভাব ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে উঠে মুক্ত মনে সরাসরি কিতাব-সুন্নাহর অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছেন। একইসাথে এই আধুনিক দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থার লৌহকঠিন প্রভাব এবং দেহমনে এর গভীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও সচেতন।

এই আধুনিক ইসলামী সাহিত্য এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর নবজাগরণের প্রচেষ্টাসমূহকে যদি দ্বীন ও ইলমেদ্বীনের পরিপক্বতার অধিকারী কিংবা ঈমানী সোহবত ও তারবিয়তের সৌভাগ্যপ্রাপ্ত নায়েবে নবী ও মুসলিহ-মুজাদ্দিদগণের কর্মপন্থার সাথে তুলনা করা হয় তাহলে এ দুই ধারার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। প্রথমোক্ত দলের কর্মতৎপরতার বড় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয়ে থাকে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অর্জন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং মানবজীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান, পক্ষান্তরে দ্বিতীয় দলের মূল লক্ষ্য হয় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন, আখিরাতের সফলতা, ঈমান ও নেক আমলের প্রেরণা এবং নবীর অনুসরণ ও আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার জযবা…’। -মানসিবে নবুওত আওর উসকে আলী মাকাম হামিলীন, পৃ. ৫৫-৫৬

আমাদের কর্তব্য, পবিত্র সীরাত ও তার ঘটনাবলির অধ্যয়ন ও নির্দেশনা গ্রহণের ক্ষেত্রে এই মৌলিক আলোচনা মনে রাখা। তাহলে আশা করা যায়, আমাদের সীরাত পাঠ আমাদের মধ্যে যথার্থ ঈমান, আমল, আল্লাহমুখিতা ও আখিরাতমুখিতা তৈরি করবে। পবিত্র সীরাতের আলোকিত সান্নিধ্য আমাদের ‘রাব্বানী’ হয়ে ওঠারই পয়গাম শোনায়।

আল্লাহ তাআলা নিজ ফযল ও করমে আমাদের তাওফীক দান করুন।

هذا وصلى الله تعالي على خير خلقه محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين،  وآخر دعونا أن الحمد لله رب العالمين.

[জুমাবার, বাদ আসর

২৭ যিলকদ ১৪৪২ হি.]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top