আলো জ্বলে না ডাকঘরে, ডাকবাক্সে আসে না আর প্রিয়জনের চিঠি- ইয়াসিন আরাফাত

আলো জ্বলে না ডাকঘরে, ডাকবাক্সে আসে না আর প্রিয়জনের চিঠি- ইয়াসিন আরাফাত

বয়সের ভারে কুজো, সম্পর্কে আমার দাদা হয়। ঝরাজীর্ণ একটা সাইকেল নিয়ে গোটা পাড়া ধাপিয়ে বেড়াতো। সাইকেলের সামনে একটা খাঁচা ছিল, সেখানে কিছু চিঠির খাম থাকতো। সময়টা তখন ২০০৫ কিংবা ২০০৬ হবে আমি হয়তবা তখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ি।তখনো আমাদের গ্রামে মোবাইল ফোনের অতটা প্রচলন ছিল না। গ্রামের বাজারে একটা ডাকঘর ছিল, দাদাকে দেখতাম সারাদিন সেখানে বসে থাকতো, আর কোন চিঠি আসলেই সাইকেলটা নিয়ে বের হয়ে যেতেন চিঠি গ্রহিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে। উনি প্রায় ৩০/৪০ বছর এই ডাকঘরে ডাকপিয়ন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বড়দের কাছ থেকে শোনা, আগে নাকি দাদার সাইকেলের খাঁচাতে চিঠির পরিমান অনেক বেশি ছিল, দিন যত পার হয়েছে চিঠির সংখ্যাও তত কমেছে। উনি মারা গেছেন ২০১০ সালের দিকে।২০০৮ সাল থেকে উনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ২ বছর আমি দাদাকে তেমন একটা চিঠি বিলি করতে দেখিনি। আর ২০১০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি আমাদের ডাকঘরে কোন মানুষকেও দেখিনি। শুনেছে এখন যিনি ডাকপিয়ন হিসেবে আছেন তার নাকি ডাকঘরে আসা তেমন একটা দরকার পড়ে না, কারন সেখানে এখন আর কোন চিঠি আসে না।

গতবছর গুগল এডসেন্স পিন ভেরিফাইডের একটা চিঠি আসছে আমার ঠিকানায়, সেই চিঠির জন্য আমি যখন বর্তমান পোস্টম্যানকে কল দিয়েছিলাম তখন তিনি কেমন যানি আশ্চর্যীত হয়েছেন।তার কর্মকালীন সময়ে এটাই মনে হয় তার প্রথম চিঠি।

তখনকার সময়ে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ হত চিঠিতে। কালের আবর্তে চিঠির আবেদন কমেছে। জায়গা করে নিয়েছে ম্যাসেঞ্জার, ইমেইল, হোয়াটস অ্যাপসহ অনেক ডিজিটাল মাধ্যম। তবে চিঠির দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই দাদার সেই ঝিমানো সাইকেলটার কথা মনে পড়ে যায়, সারাদিন পোষ্টঅফিসে বসে থাকার কথা মনে পড়ে যায়।

ছেলে গ্রাম থেকে ঢাকা গিয়েছে, মা-বাবা উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকতো ছেলে ঢাকায় পৌঁছে চিঠি লিখে সেটার জানান দিবে। প্রেমিক-প্রেমিকার একমাত্র যোগাযোগের বাহন তাদের আবেগ অনুভূতির যায়গায় ছিল এই চিঠি।

আামাদের পরবর্তী প্রজন্মের এই চিঠির সাথে পরিচিত হওয়ারও কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। জন্মের পরপরই যে শিশু মোবাইল, ট্যাব হাতে খেলনা নিয়ে বড় হয়, তার ডাক সম্পর্কে জানারও কথা নয়। তাদের কাছে এটা থাকবে অতীত, বইয়ের পাতায়, স্মৃতির মণিকোঠায়।

ছোটবেলায় অপেক্ষায় থাকতাম কখন ডাকপিয়ন এসে বড় চাচার চিঠি দিয়ে যাবে। বড় চাচা থাকতেন বিদেশে। যে দিন ডাকপিয়ন এসে বড় চাচার চিঠি দিয়ে যেত সেদিন মনে হতো বাড়িতে একটা আনন্দঘন পরিবেশ । চাচাতো ভাই বোনদের মনের মতে যেই একটা আনন্দ লক্ষ্য করতাম তাতে মনে হতো চাচা বাড়িতে আসছেন।

চাচাতো বোন জোরে জোরে চাচার চিঠি পড়তেন আর আমরা সবাই গোল হয়ে সেটা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম।

এবার আমি আমার নিজের আরেকটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- আমি যখন ক্লাস ৯ এ পড়ি, তখন আমার একটা বন্ধু ছিল। সে আমাদের সহপাঠী একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করে এবং আমাকে তাকে একটা চিঠি লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকে, তোহ একদিন আমি তাকে একটা চিঠ লিখে দেই। চিঠি লিখে দেওয়ার পর এবার সে অনুরোধ করে তার হয়ে চিঠিটা মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে এবং তার জন্য আমাকে একটা লোভনীয় অফার করে। আমিও ভালো ট্রিট এর আসায় স্কুল ছুটি হওয়ার পরে চিঠিটা মেয়েটাকে দিই। আমার থেকে চিঠি পাওয়ার পরে মেয়েটা একটা মুছকি হাসি দিয়ে চিঠিটা নিয়ে চলে যায় এবং আমার মনে হয়েছে বিষয়টা পজেটিভ। কিন্তু আমার এটা বুঝা উচিত ছিল, মেয়েটো চিঠি না পড়েই হ্যাঁ সুচক হাসি দেওয়ার মানে কি ছিল? কারন সে তো আমার ঐ বন্ধুর নামই দেখেনাই। সেই মুহুর্তে তো সে ভাবছে চিঠিখানা আমিই তাকে দিয়েছি। এগুলা ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম সকালে অন্য একটা বন্ধু বলল মেয়েটা নাকি আমাকে খুজতেছে। এটা শুনার পর আমি কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিই।পরে যখন আবার স্কুলে গেলাম মেয়েটার সামনে কোনদিনও পড়ি নাই।

এগুলো যখন এখন মনে পড়ে তখনই নস্টালজিক হয়ে যাই, এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি।

আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার ও অনুষঙ্গিক উপাদান হলো চিঠি। যা বাঙলির যাপিত জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ গাছের পাতায়, গাছের ছালে, চামড়ায়, ধাতব পাতেও চিঠি লিখত। সুতরাং বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে অন্যান্য বিষয় যেমন আমরা নতুন প্রজন্মকে খেয়াল করিয়ে দিই এবং যতটা গুরুত্ব দিই ঠিক সেভাবেই চিঠি’টাকেও জিয়িয়ে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।

এখন আর ডাকবাক্সে আসে না আর প্রিয়জনের চিঠি, মোবাইলের ইন্টারনেট চালু করলেই কিরিং কিরিং শব্দে বার্তা পৌঁছে যায় আমাদের কাছে। কিন্তু চিঠির আবেগ অনুভূতি সেটা তো আর এই ডিজিটাল ডিভাইসে পাওয়া যায় না। চিঠিতে যে প্রিয়জনের স্পর্শ ছিল সেটা তো আর এই প্রাযুক্তিক চিঠিতে পাওয়া যায় না।

—————

লেখক: ইয়াসিন আরাফাত।। https://www.facebook.com/staywitharafats

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top