চলমান বৈশ্বিক মহামন্দার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে সারা বিশ্ব

চলমান বৈশ্বিক মহামন্দার কারনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে সারা বিশ্ব

চলমান বৈশ্বিক মহামন্দার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে সারা বিশ্ব

একটি বিকাশমান উন্নয়নশীল এবং স্বল্প আয়ের দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিচারের ক্ষেত্রে দেশটির শুধুমাত্র জিডিপি, জিডিপির হার এবং মাথাপিছু আয়ের হিসেব নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে কিন্তু দেশটির প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে না। এক্ষত্রে অবশ্যই সবার আগে একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বৈদেশিক বানিজ্য (আমদানি-রপ্তানি) এর ভারসাম্য কোন পর্যায়ে রয়েছে তা বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশেষ করে একটি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশের জন্য স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (ডলার) থাকাটা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে বিগত ১৭ বছর থেকেই প্রথম স্থান ধরে রেখেছে উদীয়মান অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি রেড জায়ান চীন। মুলত ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন এবং চলমান বৈশ্বিক মহামন্দার মুখে চলতি ২০২২ সালের অক্টোবর মাস শেষে চিনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পেয়ে ৩.০৫২ ট্রিলিয়ন ডলার বা বা ৩০৫২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। অথচ গত ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.২১৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালের আগস্ট মাস শেষে ৩.২৩২ ট্রিলিয়ন ডলারের ফরেন কারেন্সির রিজার্ভ নিয়ে দেশটি সবার উপরে থাকে।

বিশ্বের এক অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ করোনা মহামারির মধ্যেও বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলেও ২০২২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২২ সালের ২৮শে অক্টোবর ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতির পরিমাণ ছিল ৫৩১.০৮ বিলিয়ন ডলার। যেখানে গত ২০২১ সালের ২৯শে অক্টোবরে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ৬৪২.০১৯ বিলিয়ন ডলার এবং গত ২০২০ সালের ৪ই সেপ্টেম্বর ভারতের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতির পরিমাণ ছিল ৫৪২.০১৩ বিলিয়ন ডলার। তবে রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেলেও সার্বিকভাবে দেশটি অর্থনিতি এখনো পর্যন্ত স্থিতিশীল ও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, গত ৯ই নভেম্বর বুধবার বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই মজুত থেকে বিভিন্ন ফান্ডে বরাদ্দ দেয়া ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে যা থাকে সেটিই হচ্ছে নেট রিজার্ভের পরিমাণ। ফলে আইএমএফ এর রক্ষণশীল রিজার্ভ নীতি অনুসরণ করে বর্তমানে বাংলাদেশের নেট রিজার্ভের পরিমাণ হয় ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত ২০২১ সালের অক্টোবর মাস শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪৬.৪৬ বিলিয়ন ডালার ছিল এবং ২০২১ সালের ২৪শে আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলারের রিজার্ভের পরিমাণ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়।

স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২ সালের ৪ই নভেম্বরে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা স্থিতির পরিমাণ মাত্র ৭.৯৫৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। যা গত ২০২১ সালের আগস্ট মাস শেষে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সর্বোচ্চ ২৭.০৬৮ বিলিয়ন ডলার এবং গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ছিল ২৫.৯৮৩ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রকাশ থাকে যে, পাকিস্তানের ডলার রিজার্ভের ৬৫% পর্যন্ত কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে বৈদেশিক ঋন ও অনুদানের ওপর নির্ভর করে। অথচ অন্যদিকে দেশটির বৈদেশিক ঋন ও দেনার পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি ২০২২ সালের জুন মাসে ১৩০.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। যেখানে কিনা  করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের ৩০শে জুন দেশটির মোট বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ ছিল ১১৩ বিলিয়ন ডলার।

তাছাড়া সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে এশিয়ার আরেক ইকনোমিক জায়ান্ট জাপানের নাম সবার উপরে উঠে এসেছে। ২০২২ সালের ৩১অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী জাপানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১.১৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়া বিশ্বের সর্বোচ্চ তৃতীয় বৈদেশিক মুদ্রা মজুতকারী দেশ হিসেবে ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের কাছে ২০২২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বরে ৮৯২.১ বিলিয়ন ডলারের সুবিশাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকে। তবে ইউকীপিডিয়ায় বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২২৯.১৬ বিলিয়ন ডলার।

চলতি ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক দিয়ে শক্তিশালী অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে যথাক্রমে তাইওয়ানের ৫৪২.৮ বিলিয়ন ডলার, রাশিয়ার ৫৪১.৬ বিলিয়ন ডলার, সৌদি ৪৬২.৯ বিলিয়ন ডলার, হংকং এর ৪১৯.২ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ার ৪১৬.৮ বিলিয়ন ডলার সিঙ্গাপুরের ২৮৬.০৭ বিলিয়ন ডলার এবং জার্মানির ২৮১.২৬ বিলিয়ন ডলারের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ মজুত ছিল। তবে চলমান বৈশ্বিক মহামন্দা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুই একটি দেশ ব্যাতিত অধিকাংশ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশাঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে

এদিকে ২০২২ সালের আগস্ট মাসের হিসেব অনুযায়ী এরদোয়ানের দেশ তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০৭ বিলিয়ন ডলার। যেখানে তুর্কী সেন্ট্রাল ব্যাংকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২১.৮৪ বিলিয়ন ডলার (বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনার রিজার্ভ) এবং ২০২১ সালের আগস্ট মাসের শেষে দেশটির ভান্ডারে কাছে ১১৭.৮ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেখানো হয়। তবে তুরস্কের আনাদুলু নিউজ এজেন্সির দেয়া তথ্যমতে, তুরস্কের সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে মোট বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ ছিল ৪৪৪.৪ বিলিয়ন ডলার।

তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকার অবস্থা একেবারেই তলানিতে নেমে গেছে। দেশটি কার্যত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকটের মুখে পাহাড় সমান বৈদেশিক ঋন ও দেনার পরিশোধের সকল ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। চলতি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৬ বিলিয়ন ডলার এবং গত সেপ্টেম্বর মাসে তা ছিল ১.৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল কিনা প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। আর বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ কিনা প্রায় ৫০.৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।

সিরাজুর রহমান, সহকারী শিক্ষক এবং লেখক,

নাটোর, বাংলাদেশ।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top